বটগাছ, ভালো আছো তো? কাউকে মনের কথা বলতে পারি না। আমি নাকি আনসোস্যাল। ফেসবুক ছেড়েছি গত তিন মাস। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেবার সময় পাই না পরীক্ষা আর কাজের চাপে। আমার মনে যে চাপা কষ্ট। তোমাকেই খুলে বলি।
কানাডিয়ান কোম্পানীতে চাকরি করি। আমরা তের জন ডেভেলপার চাকরি করছি। ৫২ জন কর্মী নিয়োগ দিয়েছিলো। সব ছাটাই হয়ে এখন তের জন আছে। তার মধ্যে আমি র্যাংকিং এ ৪ নম্বরে অবস্থান করছি। অন্যসব কর্মীদের সবার ৫+ এমবিপিএস করে ইন্টারনেট কানেকশন আছে। আমাদের কোম্পানীর প্রতি সপ্তাহের শনিবারে ভয়েজ কন্সফারেন্সিং হয়। আমি শুধু অংশ নিতে পারি না।
কোম্পানী আমাকে শুধু ধরে রেখেছে শুধুমাত্র স্কিল এর কারনে। আমি দ্রুততার সাথে কাজ করে দেই, কাজ করতে না পারলে সরাসরি না করে দেই। কখনও কখনও প্রচুর কাজ করি একটানা।
অন্যদের যোগ্যতা আমার চাইতে কম, কিন্তু তারা টিকে আছে তাদের কমিউনিকেশনের জোরে। তারা ক্লায়েন্টদের সাথে কথা বলে কাজ নেয় বলে তাদের রেট আমার দ্বিগুন অথচ, আমি তাদের চাইতে বেশী কাজ করি। আমি ক্লায়েন্টদের সাথে কমিউকেশন করতে পারি না শুধুমাত্র আমার ইন্টারনেট এর জন্য।
মাঝে মাঝে স্কাইপির চাকা ঘুরতে থাকে, আমি অফলাইন হয়ে যাই। অন্যদিকে আমার কমিউনিকেশন ম্যানেজার আমাকে অভিশাপ দিতে থাকে। আর আমি অভিশাপ দেই এদেশের ইন্টারনেট চালক (বিটিআরসির কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ) দের।
বটগাছ, তুমি তো জানো, আমি প্ররিশ্রম করে খাই। মাঝে মাঝে আমার ঘাড়, মাথা ব্যাথা হয়ে যায়। রাত্রি দুটোয় ঘুমিয়ে সকাল আটটায় পরীক্ষা দিতে যাই। তবে একটু স্ট্যাবল ইন্টারনেট পাই না কেন?
বটগাছ, তুমি হয়ত আমাকে প্রশ্ন করার চেষ্টা করছ, তোমার এতই ইন্টারনেট স্পীড দরকার তাহলে তুমি শহরে যাচ্ছ না কেন?
বটগাছ, আমি শহরে গিয়ে টিকতে পারি না। আমি ভীতু, আমি একা একা চলাফেরা করতে পারি না। সামান্য ঢাকা শহরের রাস্তা পার হতে হলে আমাকে জিপিএস এর সাহায্য নিতে পারি না। খিলক্ষেত ও খিলগাও যে পাশাপাশি না আমি তা বুঝতে পারি না। কমলাপুর থেকে টিএসসি কতদুর তা জানতে হলে আমাকে গুগল ম্যাপ ট্র্যাপ করতে হয়। আমার ছোট বোন আর ছোট ভাইদের সাথে চিল্লাচিল্লি না করতে পারলে আমার পেটের ভাত হজম হয় না। আম্মুর ছোট হয়ে যাওয়া, আমার কাছে বায়না ধরা না শুনলে আমার ভালো লাগে না। সংসার আমার উপর তুলে দিয়ে কোন প্রকার চিন্তা ছাড়াই আমার বাবার দার্শনিকের মত ট্রাভেল করতে বিভিন্ন যায়গায় যাওয়া না দেখলে ভালো লাগে না। আম্মুর মাখিয়ে দেওয়া ভাত না খেলে ভাল লাগে না। তাহলে আমি শহরে থাকবো কেমন করে?
বটগাছ, তুমি জানো, সবকিছু সহ্য করে আমি শহরে গিয়েছিলাম আউটসোর্সিং প্রশিক্ষণ দিতে। সেখানে প্রশিক্ষণ দিয়ে আজ ২০-২৫ জন ছেলে আশার আলো খুজে পেয়েছে। তারা আয় করছে। কিন্তু সেখানে একটি পক্ষের হাতে আমি কেন শোষিত হলাম? কেন তারা আমার কাছে চাদা দাবি করল? বটগাছ, মুখে মুখে কিন্তু তারা অনেক কথাই বলত।
বটগাছ, সব ছেড়ে আমি এখন গ্রামে। এখানে চার ঘন্টা লোড শেডিং। তাই জেনারেটর কিনেছি। কিন্তু স্কাইপির চাকা ঘুরলে তো কিছু করতে পারবন না। বিশাল আইটি কোম্পানী দেবার পরিকল্পনা করছি। না হয়, একটা মিনি বিদুৎ কেন্দ্র দিলাম। কিন্তু ইন্টারনেট কোথায় পাবো?
বটগাছ, শুনেছিলাম ব্রডব্যান্ড কানেকশন পাবো। সেজন্য টিএনটি লাইন নিলাম সরকারী কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে। এখন লাইন পাচ্ছি না। আবার নাকি ঘুষ দিতে হবে। সত্য কথা বললে বিপদ। ফোরজি, থ্রিজি সব আছে শহরে। আমাদের গ্রামে কিছু নেই।
বটগাছ, আমি যদি গ্রামে থেকে এক হাজার লোকের কর্মসংস্থান করতে পারি, তাহলে কি শহরের উপর চাপ কমবে না? শহরে যানজট কম হবে না? গ্রামের প্রা্কৃতিক পরিবেশে থেকে সবাই সুস্থ্য থাকবে না? তাহলে কেন আমাদের এখানে প্রযুক্তি আসে না? কেন? কেন? কেন?
জানি তোমার কোন উত্তর নেই। তুমি শুধু চুপ করে শুনেই যাবে। বটগাছ তুমি শুনেই যাও। অন্তত তুমি শুনতে তো পারো। আমার এই কষ্ট দেখার যে কেউ নেই।