Quantcast
Channel: প্রজন্ম ফোরাম
Viewing all articles
Browse latest Browse all 15150

সোলায়মান চেয়ারম্যান

$
0
0

[একটা উপন্যাস লিখছি। নাম ঠিক করিনি। সেটার একটা অংশ সোলায়মান চেয়ারম্যান।]

নবীগঞ্জ উপজেলার ইউএনও অফিসে খানিকটা জড়সড় ভঙ্গিতে বসে আছে সোলায়মান। পুরা নাম মোহাম্মোদ সোলায়মান। পরিপাটি করে আচড়ানো চুলের তামাটে চেহারার দীর্ঘদেহী সোলায়মানের এরকমভাবে বসে থাকার কোন কারণ নাই। কারণ সে নিজে এই উপজেলার চেয়ারম্যান। কিন্তু তারপরেও সে অস্বস্তিতে আছে। অস্বস্তির কারণ অফিসের ইউএনও সালমা খাতুন। সুন্দরী নারীর প্রেমে পড়লে খানিকটা অস্বস্তি হবেই। আর সেই সাথে সুন্দরী নারীটি যদি মারাত্বক ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এবং রাগী হয়, তাহলে সেই অস্বস্তি রূপান্তরিত হয় আতঙ্কে। এটাই স্বাভাবিক।

সচারচর উপজেলা চেয়ারম্যানরা যেরকম হয়, সোলায়মান সেরকম না। সে প্রাথমিক শিক্ষার জন্যে দেয়া ফ্রি বই একেবারে ঠিকমতন বিতরণ করে, রিলিফের মাল চুরি করেনা, আবার উন্নোয়ন তহবীল থেকে আসা সরকারী বরাদ্দের টাকাও এদিকওদিক করেনা। ধনাঢ্য পরিবারের একমাত্র সন্তান হওয়ায় তার টাকাপয়সার অভাব নেই, প্রয়োজনও নেই।  তবে সতন্ত্রপ্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হওয়ায় তার রাজনৈতিক ক্ষমতার দাপটও নাই। কিন্তু তার ব্যাপক জনপ্রিয়তা আছে। মানুষ তাকে মারাত্বক পছন্দ করে। তার নির্বাচনে আসার ঘটনাটাও কাকতালীয়। তৎকালীন চেয়ারম্যান এবং স্থানীয় হাইস্কুলের ম্যানেজিং কমিটির প্রধান, একদিন জনসমক্ষে সেই স্কুলের হেডমাস্টারকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে কান ধরে উঠবস করায়। এটা দেখে মাথায় রক্ত উঠে যায় সোলায়মানের। ছাত্র হিসেবে সে ছিলো মোটামুটি মানের। কিন্তু শিক্ষকদের অত্যন্ত সন্মান করতো। এখনও করে। শিক্ষকরাও তার এই গুনটির জন্যে ভালো ছাত্রদের পাশাপাশি তাকেও অত্যন্ত স্নেহ করেন। সেই মুহূর্তে তার প্রয়াত পিতার কথা মনে পড়ে যায়। “শিক্ষকর মনো কষ্ট দিলাইলি তো কবিরা গুনাহ করলি।” হাতের কাছে পড়ে থাকা চেলা কাঠ নিয়ে চেয়ারম্যান আর সাঙ্গোপাঙ্গোদের বেদম প্রহার করে সোলায়মান। তার এরকম রুদ্রমুর্তি  দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় চেয়ারম্যান গং। ভয়ে এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে না পারা দাঁড়িয়ে থাকা জনগণও এগিয়ে আসে সোলায়মানকে সাহায্য করতে। এই ঘটনাটাই জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয় সোলায়মানের। কয়েকদিন পরেই হওয়া নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়ে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে সে।     

ঘড়ির কাটা ধরে ঠিক দশটার সময় অফিসে ঢোকে সালমা। সব মানুষেরই কর্মক্ষেত্রে সময় মেনে চলা উচিত। আর মানুষটা যদি নারী হয়, তাহলে তাকে আরও বেশি সময় মেনে চলতে হয়। বলতে খারাপ শোনালেও, আজও পুরুষশাসিত এই সমাজে নারীদের ভুল্ভ্রান্তি ধরার জন্যে মানুষ মুখিয়ে থাকে। আর তার মতন এরকম সরকারী পদে চাকুরি করা কর্মকর্তা যদি নারী হয় তাহলে তো কথাই নেই। অফিসে ঢুকেই তার জন্যে অপেক্ষারত সোলায়মানকে দেখতে পায় সালমা। সোলায়মানকে ছোটবেলা থেকে খুব ভালোমতন চেনে সালমা। ও যখন ছোট ছিলো তখন ওর বাবা শিক্ষা অফিসার হিসেবে আসেন এ উপজেলায়। তখন বেশ কয়েক বছর তাদের এ এলাকায় থাকতে হয়। তখন প্রায় সময় সোলায়মান ওর স্কুল আর কলেজের গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতো। কখনও কোন অসভ্যতা করেনি ওর সাথে। কিন্তু সালমা একদমই পাত্তা দেয়নি। ছেলেরা হচ্ছে বাঁদরের মতন। পাত্তা দিলে মাথায় চড়ে বসে। নিজের ক্যারিয়ার ওর কাছে সর্বোচ্চ গুরুত্ব পেতো। লুতুপুতু প্রেম করে ক্যারিয়ারের বারোটা বাজানোর মতন মেয়ে ও কখনোই ছিলো না।

আমাদের সমাজের কিছু অলিখিত নিয়ম আছে। যেমন শিক্ষকের সন্তান শিক্ষক হবে, ব্যবসায়ীর সন্তান ব্যবসায়ী, নেতার সন্তান নেতা আর সরকারী চাকুরের সন্তান সরকারী চাকুরে। সেই নিয়ম মেনে সালমাও তার বাবার মতন সরকারী কর্মকর্তা। এতো বছর পরে চাকরীসূত্রে এই এলাকায় আসার পরে সোলায়মানকে উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে পেয়ে যারপরণাই অবাক হয়েছে সালমা। কারণ সোলায়মানের বাবা ছিলেন ব্যবসায়ী। বাবার মতন ব্যবসায় না গিয়ে সে হয়েছে রাজনীতিবিদ। তাও দল ছাড়া। দল ছাড়া নেতা হওয়া, আর ঢাল-তলোয়ার ছাড়া নিধুরামসর্দার হওয়া একই কথা। আবার তথাকথিত অন্যান্য চেয়ারম্যানেদের মতন তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগও নেই। সবদিক দিয়েই সোলায়মান ব্যতিক্রম। তবে আজকাল আমরা প্রথা ভাঙ্গার প্রতিযোগিতায় নেমেছি। তাই এই অলিখিত নিয়ম ভেঙ্গে ব্যবসায়ীরা হচ্ছেন রাজনীতিবিদ, আর রাজনীতিবিদরা নামছেন ব্যবসায়।

প্রথম যেদিন উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে তার সাথে সালমার পরিচয় হয়, তখন সোলায়মান খুব পরিচিতজনের মতন ওর সাথে কথা বলতে আসলেও সালমা ভালোমতন বুঝিয়ে দেয় যে, ওকে তার মনে নেই। কারণ চোখ দেখেই বোঝা যায় যে, সে সালমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে এবং এখনও সে সালমার মতনই অকৃতদার। এর আগে যে কয় জায়গায় সালমার পোস্টিং হয়েছে, সবখানে একইরকম সমস্যা পোহাতে হয়েছে তাকে। সবাই তার প্রেমে হাবুডুবু খায়। এই সমাজে নারী হওয়া যেন একটা অপরাধ। তারচেয়ে বড় অপরাধ চেহারাসুরত ভালো হওয়া আর অবিবাহিত থাকা। এইতো কয়েকদিন আগেও খবরের কাগজে এলো, পুলিশের এক মহিলা এ.এস.আই কে উক্তোক্তকারী বখাটের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের। কত বড় সাহস! সমাজের নিরাপত্তারক্ষী অস্ত্রবহনকারীরাও এই নর্দমার কীটগুলোর হাত থেকে রেহাই পায়না শুধুমাত্র নারী হবার কারণে! এই নরকের কীটগুলোর যোগ্যতা একটাই যে তারা পুরুষ। সমাজের এসব ফালতু ধরনের নিয়মনীতি ভাঙতে আর সস্তা মানসিকতা পাল্টাতে বদ্ধপরিকর সালমা। এসব ব্যাপারে তার মা-বাবা যথেষ্ট সাহায্য করে ওকে। এজন্যে মনে মনে আরও একবার তাদের ধন্যবাদ দেয় সে।

সালমাকে দেখেই উঠে দাঁড়ায় সোলায়মান। প্রতি মানুষেরই কিছু দুর্বল জায়গা থাকে। যেমন সোলায়মান। কোন এক অজানা কারণে স্থানীয় মানুষজন তার নাম বিকৃত করে উচ্চারণ করে সোলেমান। ওর নাম বিকৃত করে উচ্চারণ করলেই সে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে। ইচ্ছে করে ওকে একটু ক্ষেপিয়ে দেয়ার জন্যে সালমা বলে ওঠে,
-    কি ব্যাপার সোলেমান সাহেব, একেবারে সাতসকালে অফিসে হাজির। জরুরী কিছু?

অন্য কেউ হলে এতোক্ষণে একটা হুলুস্থুল করে ফেলতো সোলায়মান। নাম বিকৃতকারীদের বিরুদ্ধে এমন করাও উচিত। বিকৃত উচ্চারণকারীদের বিরুদ্ধে সরব না হলে বড় ধরনের ক্রাইসিস  তৈরী হতে পারে। যেমন, তাদেরই ইউনিয়নের এক লোকের নাম ভত্তা। প্রকৃতিপক্ষে লোকটার নাম ছিলো আবুল ফাত্তাহ। সেখান থেকে সংক্ষিপ্ত হয়ে হলো ফাত্তা। সেটা আরও বিকৃত হয়ে হলো ভত্তা! লোকজন বাসায় এসে জিজ্ঞেস করে, “বাসাত ভত্তা আছেনি?” কি বিচ্ছিরি ব্যাপার! আবার আরেকজনের নাম ছিলো সাইফুল্লাহ। কিন্তু কাবিল লোকজনের বিকৃত উচ্চারণের বদৌলতে সে এখন ছয়পাল্লা। এখানে শেষ হলে ভালোই ছিলো। ছয়পাল্লার নামে অনুপ্রাণিত হয়ে কয়েকদিন আগে এক নবজাতকের নাম রাখা হয়েছে নয়পাল্লা! তাও আবার আকিকা করে! এতো কিছুর পরেও সালমার উপর ক্ষিপ্ত হতে পারে না সোলায়মান। পুরো জিনিসটা বরাবরের মতন হজম করে। প্রেমে পড়া মানুষদের এরকম অক্ষমতা মাঝে মাঝে বড়ই পীড়াদায়ক।
-    জ্বী। আসলে আফনার কাছে এখটা আবদার খরতাম।
-     এখটা, খরতাম, এগুলো আবার কি? এটা একটা অফিস। আঞ্চলিক ভাষা বাদ দিয়ে চলিত ভাষা বলুন। একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে এটাতো অন্তত জানা উচিত আপনার। আর আবদার আবার কি? আমি কি আপনার মা নাকি?
কথার শুরুতেই এমন জবাব পেয়ে খানিকটা চুপসে যায় সোলায়মান। তবে সালমার কথা ঠিক। নারী জাতির মধ্যে পুরুষরা আবদার করতে পারে শুধু মা-খালাদের কাছে। প্রেমিকা বা স্ত্রীর কাছে আবদার করা যায়না। সমস্ত আবদার শুধু তারাই করতে পারবে। পুরুষদের সে অধিকার নেই। জগতের কিছু নিয়ম বড়ই কঠিন।
-    জ্বী না। আসলে ভুল অই গেছে... থুক্কু... হয়ে গিয়েছে। আসলে বলতে চাচ্ছিলাম যে, কালিয়ারভাঙা ইউনিয়নে বিলের কাছে একজন বাবা এসেছে। লোকজন বলছে সে নাকি “হাঁটা বাবা”। সারাদিন সারারাত হেঁটে বেড়ায়। খানাখাদ্য গ্রহণ করেনা। আবার মানুষকে ছুঁয়ে দিয়ে তাদের রোগবালাই সারিয়ে দিচ্ছে। আসলে এইগুলো তো বেশিরভাগ ভন্ড হয়। গ্রামের সহজ-সরল মানুষগুলোকে ধোঁকা দিয়ে টাকাপয়সা কামায়। সেজন্যে ব্যাপারটা দেখতে যাচ্ছিলাম। ভাবলাম আপনাকে সাথী করি। আপনিতো এসব ব্যাপারে অনেক কড়া।

প্রকৃতপক্ষে এসব ভন্ডকে শায়েস্তা করতে সোলায়মান একাই যথেষ্ট। শুধুমাত্র কিছু সময়ের জন্যে সালমার সংগ পাবার আশায় ও এখানে এসেছে। এখন সালমা রাজি হলেই হয়, মনে মনে ভাবে সোলায়মান।
সালমার শক্ত হয়ে যাওয়া চোয়াল থেকে বুঝতে অসুবিধা হয়না যে, সে সোলায়মানের কথাগুলো বেশ গুরুত্বের সাথে নিয়েছে।
-    আপনি কিসের ঘোড়ার ডিমের চেয়ারম্যান হয়েছেন আমি বুঝিনা। এই ভন্ডগুলো ঢোকার সাহস পায় কিভাবে? 
-    জ্বী, আমিতো জানতাম না। আজকে খবর পেয়েছি। খবর পাওয়া মাত্রই আপনার কাছে ছুটে এসেছি। 
সোলায়মানের আত্মসমর্পনের ভঙ্গিতে সাহায্য চাওয়া দেখে ভালো লাগে সালমার। সুন্দরী নারীরা আত্মগরিমায় টইটুম্বুর পুরুষদের পছন্দ করেনা। পছন্দ করে আত্মসমর্পনকারী বিনয়ী পুরুষদের। সালমাও তার ব্যতিক্রম নয়।
-    নো। নেভার। আমার উপজেলায় এসব ভন্ডামি চলবেনা। এখুনি গিয়ে ব্যাটাকে ঘাড় ধাক্কা দিতে হবে।
সালমা তার পিএস এর দিকে তাকিয়ে গাড়ি বের করার নির্দেশ দেয়। এটা শুনে মুখটা পাংশু করে ফেলে সোলায়মান। ভেবেছিলো সালমাকে নিয়ে তার নিজের গাড়িতে করে যাবে। সে আশা পন্ডো হয়ে যাচ্ছে দেখে খুবই সতর্কতার সাথে বলে ওঠে,
-    জ্বী, আমি সাথে গাড়ি এনেছি।
-    সেটা আমি জানি সোলায়মান সাহেব। সরকার যে উপজেলা চেয়ারম্যানদের গাড়ি বরাদ্দ দিয়েছে তা সবাই জানে। ঢোল পেটাতে হবেনা।
সালমার কথা শুনে খানিকটা বিব্রতবোধ করে সোলায়মান। কিন্তু একই সাথে আশাবাদী হয়, কারণ সালমা সঠিকভাবে তার নামটা উচ্চারণ করেছে।
-    জ্বী আসলে, একই জায়গায় যাওয়ার জন্যে দুটো গাড়ি ব্যবহারের তো কোন দরকার নাই। সরকারী তেলের অপচয়। সেজন্যে বলছিলাম আরকি।
-    জ্বী। সে কথা আমিও জানি। এজন্যেই একটা গাড়ি ব্যবহার করবো। আপনি আমার সাথে আমার গাড়িতে যাবেন। আবার

ফেরত আসার সময় ফেরত আসবেন। তারপর এখান থেকে আপনার গাড়ি নিয়ে যেখানে যাবার যাবেন।
সোলায়মানের মনে খুশির হিল্লোল বয়ে যায়। চেহারায় খুশির ঝিলিকটা চাপা দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা চালায়। আজ কার মুখ দেখে ঘুম ভেঙ্গেছে তা মনে করার চেষ্টা করতে থাকে সে। বাসায় গিয়ে তাকে চারটা ভালোমন্দ খাওয়াতে হবে। সালমার সংগ লাভের আনন্দে পুলকিত হয়ে গাড়িতে ওঠার জন্যে পা বাড়ায় উপজেলা চেয়ারম্যান সোলায়মান।


Viewing all articles
Browse latest Browse all 15150

Trending Articles



<script src="https://jsc.adskeeper.com/r/s/rssing.com.1596347.js" async> </script>