খাদ্য অপচয় বন্ধ বা কমিয়ে আনা বিশ্ব প্রেক্ষাপটে যেমন জরুরি তেমনি জরুরি আমাদের দেশের জন্যও। বাংলাদেশের বর্ধিষ্ণু জনসংখ্যার খাদ্য আর পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ও কৃষকের আয়ের পথকে সুগম করতে হলে উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে খাদ্য অপচয় রোধ করা আমাদের জন্য একটি প্রধান বিবেচ্য বিষয়। বাংলাদেশে খাদ্য অপচয় যে কত রকমভাবে হয়ে থাকে তা আমাদের অজানা নয়। ফসল উৎপাদন থেকে আহার পর্যন্ত প্রতি পদক্ষেপে আমাদের খাদ্যের অপচয় রীতিমত শঙ্কার। যদিও খাদ্য অপচয়ের পরিসংখ্যান সঠিকভাবে কোথাও গ্রন্থিত হয়নি তবুও বিভিন্ন সূত্র থেকে যা আমরা জেনেছি তা আমাদের অনাগত ভবিষ্যতের জন্য এক অশনি সংকেত। একটি সমীক্ষায় জানা গেছে- বিশ্বের খাদ্যের ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ যা প্রায় ১.২ থেকে ২ বিলিয়ন টন কখনই ভোক্তার কাছে পৌঁছে না। গড় হিসাব করলে দেখা যায়, বিশ্বের জনগণ প্রয়োজনের তুলনায় ১০ শতাংশ খাবার বেশি খায় আর ফেলে দেয় আরো ৯ শতাংশের মতো। সংগৃহীত ফসলের প্রায় অর্ধেকই অপচয় হয় অতিরিক্ত ভোজন, ভোক্তার দ্বারা অপচয় আর ফসল উৎপাদন থেকে সংগ্রহ পর্যন্ত অদক্ষ ব্যবস্থাপনার কারণে। এর সঙ্গে রয়েছে প্রকৃতির বৈরিতা। আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এই অপচয় কমাতে হবে। কয়েক বছর আগের বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশের ৩২ শতাংশের অধিক কাঁঠাল, ৩০ শতাংশের অধিক কলা, ২৮ শতাংশ টমেটো, ২৫ শতাংশ বাঁধাকপি সংগ্রহ পরবর্তী সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে যায়। কাঁঠাল, কলা আর টমেটোর অপচয়ের পরিমাণ যথাক্রমে সোয়া ৩ লাখ, ২.৫ লাখ ও ৬৫ হাজার টনেরও বেশি। অন্যসব ফল ও সবজির ক্ষেত্রেও এই অপচয় উদ্বেগজনক। ফসলের মাঠে রোগবালাইয়ের সংক্রমণের ফলে কত সহস্র কোটি টাকার ফসল নষ্ট হচ্ছে তা হিসাব করলে আমাদের রীতিমত অবাক হতে হবে। আর প্রতিদিন আমাদের ফসলের ক্ষেতে প্রাদুর্ভাব হচ্ছে নতুন নতুন রোগবালাইয়ের। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ঢাকা শহরের বর্জ্যের প্রায় শতকরা ৬০ ভাগ শহরের অপচয়কৃত খাদ্য থেকে আসে। দেশের খাদ্য অপচয়ের চিত্র আমাদের সবাইকে নিশ্চিতভাবে বিচলিত করছে। আমাদের এ থেকে আশু পরিত্রাণ প্রয়োজন। আমাদের কৃষি উন্নয়নকে স্থায়ী করতে এবং খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে খাদ্য অপচয় রোধে সমন্বিত দিক-নির্দেশনার প্রয়োজন। ফসলের মাঠে অযাচিত রোগ-বালাইয়ের কারণে খাদ্যশস্য অপচয় রোধে সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম, প্রস্তুতি ও ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। ভালো খামার ব্যবস্থাপনা চর্চা, যা উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের কৃষির রক্ষাকবচ, আমাদের দেশেও এটাকে যথাযথভাবে গ্রহণ করতে হবে। আমাদের দেশের কৃষক দীর্ঘ পথচলায় বৈরী প্রকৃতির কাছে মাথা নত করেনি, তবুও প্রাকৃতিক বৈরিতাকে সহজে জয় করবার মতো করে আমাদের কৃষি ব্যবস্থাপনাকে সাজাতে হবে। উৎপাদনকারীরা সহজে যাতে সংরক্ষণাগার ও প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে তুলতে পারে এজন্য সরকার ও অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। দেশের বাইরে আমাদের ফল ও সবজির বাজার তৈরিতে আরো বেশি তৎপর হতে হবে। পারিবারিকভাবে আমাদের বিবেচনায় আনতে হবে খাদ্য অপচয় একটি গর্হিত কাজ। এ ব্যাপারে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। একটি সুখী সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে হলে সবার আগে সকলের একাগ্রতা ও নিষ্ঠার প্রয়োজন।
↧