“কত ভাগ্যের ফলে না জানি,
মন রে, পেয়েছ এই মানব-তরণী”
কথাটা লালনের একটি গানের। আসলেই, কত ভাগ্যের ফলে এই মানব জনম পেয়েছি আমরা! কিন্তু এই মানব জনমের উদ্দেশ্য কি? কোন উদ্দেশ্য কি সত্যিই আছে?
আছে। পরম প্রাপ্তির এই মানব জনমের উদ্দেশ্য হল ভালো রেজাল্ট করা। না, না, হাসবেন না। সত্যিই এই মানব জনমের উদ্দেশ্য হল ভালো রেজাল্ট করা! আপনার ছোটবেলার কথা মনে করুন তো। আপনার বাবা-মা কি বলছে শুনতে পাচ্ছেন?
-বাবু, তোমাকে আরও ভালো রেজাল্ট করতে হবে। অংকতে একশতে একশ পেতে হবে। ফার্স্ট হতে হবে।
-লেখাপড়া করে যে, গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে।
-দেখেছো, ও কত্ত ভালো রেজাল্ট করেছে! তোমাকেও এমন ভালো করতে হবে।
-তোমাকে ফার্স্ট হতে বলছি না।শুধু এক থেকে দশের ভেতরে থাকো! এটাও পারবা না?
কি? শুনতে পাচ্ছেন? এবার তাহলে বলুন তো আপনার জন্ম কি তাহলে এই ভালো রেজাল্টের জন্যই হল না? ভুল কিছু বলেছি?
তাহলে এখন একটা সিদ্ধান্তে আসা যায়। যারা ভালো রেজাল্ট করতে পেরেছে বা পারছে তারা তাদের জীবনের উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারছে, তাদের জীবন সফল। আর যারা খারাপ রেজাল্ট করছে তারা তাদের জীবনের উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারছে না। কাজেই তাদের জীবন ব্যর্থ! সোজা হিসাব!
তার মানে একজন লোক যে তার ছাত্রজীবনে কোনদিন ভালো রেজাল্ট করতে পারেনি, কোন রকমে পড়াশোনাটা শেষ করে একটা ছোট খাটো চাকরি করে সংসার চালাচ্ছে তার জীবনটাও ব্যর্থ।
একজন রিক্সাওয়ালা তো পড়ালেখাই করতে পারলো না! তার আবার জীবনে সফলতা ব্যর্থতা আছে নাকি? তার ওটাকে তো জীবনই বলা চলে না। যদিও তারই ঘাম ঝরানো উপার্জনের টাকায় আরও কিছু বাড়তি জীবন বেঁচে থাকে।
আচ্ছা ভালো কথা, খুব সফল মানুষকে বলছি- শুধু মাত্র একদিন, মাত্র পুরো একটা দিন রিক্সা চালাতে পারবেন?
-আরে ভাই, আপনি তো আজব কথা বলেন! রিক্সা চালাবো না দেখেই তো পড়াশোনা করেছি! যেন ওই কঠিন জীবনযাপন করতে না হয়।
তার মানে পারবেন না তাই তো? তাহলে এই রিক্সা চালানো ব্যাপারটাতে কে ব্যর্থ? ওই রিক্সাওয়ালা না আপনি? তাহলে ওই জীবনটাকে ব্যর্থ বলছেন কোন হিসাবে?
আপনি যেমন সফল ভাবে একটা সার্জারি করে রোগীকে কষ্ট থেকে বাঁচান তেমনি সেও সফল ভাবে তার কাজটা শেষ করে মানুষকে কষ্ট থেকে বাঁচায়। আপনি যেমন সফল, সেও সফল! আপনি আপনার জায়গায় সফল, উনি উনার জায়গায় সফল। সোজা হিসাব!
একজন চায়ের দোকানদার, একজন পান সিগারেটের দোকানদার, একজন মিস্ত্রী, মেকার, মুচি... এদের সবার জীবন ব্যর্থ!!!???
এদের প্রত্যেকের এই কাজগুলোর ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করে একটা সংসার দিব্যি চলছে। তার স্ত্রী-সন্তানরা খেয়ে পরে বেঁচে থাকছে। তবুও সে ব্যর্থ? একটা সংসার চালানো কি এত সহজ?
কিছু কি বোঝা যাচ্ছে?
হ্যাঁ ভাই, আমরা সবাই সফল! কেউ ব্যর্থ না।
কিন্তু সমস্যা এখানে শেষ না। ছোটবেলা থেকেই একটা কথা সবাই বলে, “তোমাকে অনেক বড় হতে হবে।”
এই লাইনটা একটা ভুয়া লাইন। ঠিক কি বোঝানো হচ্ছে এই লাইন দিয়ে সেটাই বোঝা যায় না! বড় হতে হবে মানে ঠিক কি হতে হবে? কোন কাজটায় বড় হতে হবে? বড় হতে হবেই বা কেন? বড় না হলেই বা কি হবে?
হুম... বড় হতে হবে। বড় হতে হবে মনের দিক দিয়ে। বড় হতে হবে প্রতিটি প্রাণের প্রতি ভালোবাসায়। বড় হতে হবে নিজের কাছে!
ভালো মার্কসে, বড় চাকরিতে, অঢেল সম্পদে কেউ বড় হয় না। মানুষ বড় হয় মনুষ্যত্বে।
আচ্ছা আমি কি বোঝাতে পেরেছি ছোটবেলা থেকে আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য হিসেবে যা বোঝানো হচ্ছে তা পুরোটাই একটা ভুল??? নাকি এটা বোঝাতেও ব্যার্থ হয়েছি? মজার ব্যাপারটা এখানেই, কারও কাছে আমি বোঝাতে সফল আর কারও কাছে বোঝাতে ব্যর্থ!
যাই হোক, এবার প্রশ্ন হল, আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য কি তাহলে?
এটার উত্তর আমি দেবো না। তবে এই বিষয়ে আমার খুবই প্রিয় কিছু লাইন আছে। হুমায়ূন আহমেদ তার “তেতুল বনে জোছনা” বইয়ের বিজ্ঞাপনে এই চরণগুলি লেখেন।
“মাঝে মাঝে আমার খুব কবিতা লিখতে ইচ্ছা করে। তখন কাগজ কলম নিয়ে বসি এবং খুব আয়োজন করে কবিতার একটা নাম ঠিক করি। ব্যাস এই পর্যন্তই। কবিতার শিরোনাম লেখা হয় কবিতা আর লেখা হয় না। বুদ্ধিমান পাঠক আশা করি এর মধ্যেই ধরে ফেলেছেন যে “তেতুল বনে জোছনা” আসলে আমার একটা কবিতার নাম। যে কবিতা লেখা হয় নি, এবং কখনো লেখা হবে না। কেউ যদি প্রশ্ন করেন-“এই নামের অর্থ কি? তেতুল বনে জোছনা কি আলাদা কিছু?” তাহলে আমি বিপদে পড়ে যাব। আসলেই তো এর কোনো অর্থ কি আছে? প্রশ্নটাকে এখন একটু ছড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। আলোর অর্থ কি? বর্ষার মেঘমালার অর্থ কি ? যে অনন্ত নক্ষত্র বীথি আমাদের ঘিরে রেখেছে তার অর্থ কি? আচ্ছা আমরা কি অর্থহীন একটা জগতে বাস করে জীবনের অর্থ অনুসন্ধান করছি না? কেন করছি?”
লালনের গানের দুটো লাইন দিয়ে শুরু করেছিলাম। গানটার প্রথম লাইনটা বলি-
“এমন মানব জনম আর কি হবে?
মন যা কর, ত্বরায় কর এই ভবে।।”
এই ‘মন যা কর’ কথাটাতেই কিন্তু জীবনের উদ্দেশ্য লুকিয়ে আছে!
↧
জীবনের উদ্দেশ্য
↧