Quantcast
Channel: প্রজন্ম ফোরাম
Viewing all articles
Browse latest Browse all 15150

ভারতে ধর্মচিন্তার ক্রমবিকাশ--বহিরাগত ধর্মমত

$
0
0

O ভারতে ধর্মচিন্তার ক্রমবিকাশ--বহিরাগত ধর্মমত O
খ্ৰীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতক থেকেই ভারতে বহিরাগত শক্তিগুলির অনুপ্রবেশ শুরু হয়েছিল। রাজনৈতিক কারণে এই সকল অভিযান ঘটলেও, অভিযানকারীদের সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতিও ভারতে প্রবেশ করে। বলাবাহুল্য যে এই সকল বহিরাগত জীবনধারা, ধর্মভাবনা সামান্যভাবে হলেও ভারতের সনাতন সংস্কৃতির উপর প্রভাব ফেলে। আলেকজাণ্ডারের আক্রমণের সূত্রে এদেশে বহু গ্ৰীক স্থায়ী বসবাস শুরু করেছিল। প্রাচীন ভারতীয় ধর্মাচারের কিছু কিছু পদ্ধতির সাথে গ্ৰীসের ধর্মাচারের সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া অসম্ভব নয়। যেমন--- বাংলার চড়কসংক্রান্তির অনুষ্ঠানে শিব-পার্বতীকে সং সাজিয়ে আনন্দানুষ্ঠানের সাথে এথেন্সের দিওনিমোসের অনুষ্ঠানের মিল অনেকটাই।
একইভাবে মোশি প্রচারিত ইহুদি ‘প্ৰভুবাদ’-এর অনুগামীরাও খ্ৰীষ্টীয় দ্বিতীয় শতকের আগেই ভারতে বাণিজ্যসূত্রে প্ৰবেশ করে বসবাস শুরু করেছিল। অবশ্য ভারতীয় ধর্মের ক্রমবিকাশের ধারায় এই মতবাদের কোন প্রত্যক্ষ যোগ ছিল না। তবে কিছু আগে-পরে ভারতে অনুপ্রবিষ্ট খ্ৰীষ্টান ও ইসলাম ধর্ম নিঃসন্দেহে ভারতে ধর্ম-চিন্তার ক্রমবিকাশের ধারায় সুদূরপ্রসারী প্রভাব ও পরিবর্তনের সক্রিয় অংশীদার।
O ভারতে খ্ৰীষ্ট ধর্ম O
খ্রীষ্টীয় প্রথম শতকেই ভারতে খ্ৰীষ্টধর্মের আবির্ভাব ঘটেছিল বলে মনে করা হয়। বর্তমান ভারতে খ্ৰীষ্টধর্মাবলম্বীর সংখ্যা সওয়া এক কোটির মত। কেরলেই ভারতীয় খ্ৰীষ্টানের সংখ্যা সর্বাধিক। দ্বিতীয় স্থান সম্ভবত গোয়ার। এর পর মাদ্রাজ, বোম্বাই সহ ভারতের প্রায় সকল অংশেই খ্ৰীষ্টধর্মাবলম্বীদের দেখা যায়। একদিকে শহুরে শিক্ষিত মানুষ অন্যদিকে গ্রামীণ উপজাতি গোষ্ঠীর মধ্যে খ্ৰীষ্টধর্মের প্রভাব তুলনামূলক ভাবে বেশী।
কথিত আছে, খ্রীষ্টের বারোজিন প্রত্যক্ষ শিষ্যের অন্যতম সেন্ট টমাস প্রথম শতকে ভারতে এসে মহান যীশুর বাণী প্রচার করেছিলেন। মালাবার অঞ্চলের উচ্চবংশীয় কিছু মানুষ টমাসের কাছে ধর্মান্তর গ্রহণ করে খ্ৰীষ্টান যাজকের বৃত্তি নেন। এরাই ভারতের প্রথম ধর্মান্তরিত খ্ৰীষ্টান। ধমীয় অসহিষ্ণুতার কারণেই মাদ্রাজে সেন্ট টমাস নিহত হন। মাদ্রাজ শহরে অবস্থিত সেন্ট টমাস মাউণ্ড” সাধু টমাসের সমাধির অবশেষ বলেই মনে করা হয়। চতুর্থ শতকের মধ্যে ভারতের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে খ্ৰীষ্টধর্মের যথেষ্ট প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
সিরীয় খ্ৰীষ্টানরাই ভারতে প্ৰথম আসেন। মহান যীশুর উদার ও মানবতাবাদী আদর্শ প্রচার করে এরা ভারতবাসীর হৃদয়ে স্থান করে নিতে সক্ষম হন। তবে এর গুণগত ও পরিমাণগত গুরুত্ব ছিল নগণ্য। পরবর্তীকালে খ্রীষ্টধর্মের বার্তাবাহী-মিশনারীদের আত্মম্ভরিতা ও উন্ন্যাসিকতা কার্যতঃ ভারতীয়দের খ্ৰীষ্টভাবাদর্শ থেকে দূরেই সরিয়ে দেয়। তবে পর্তুগীজ, ফরাসী, ইংরেজ প্রভৃতির রাজনৈতিক কর্তৃত্ব এবং একশ্রেণীর ভারতবাসীর আর্থিক দুৰ্গতি নানা বাধা সত্ত্বেও একাংশ ভারতীয়কে ধর্মান্তর গ্রহণে বাধ্য বা প্ররোচিত করেছিল। যদিও ভারতীয় ধর্ম ও সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে তাদের ভ্রান্তি, উদাসীনতা ও সক্রিয় অবজ্ঞার জন্য মিশনারীদের বাণী ভারতবাসীর হৃদয় সম্পর্শ করতে পারেনি।
প্রতিটি ভারতীয়র চেতনায় যীশুখ্রিষ্ট পরম শ্রদ্ধাস্পদ মহামানব। তার অনাড়ম্বর জীবনধারা, ত্যাগের বাণী, বৈরাগ্য, মানবতার আদর্শ ভারতের চিরন্তন ধর্মচেতনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু খ্ৰীষ্টান ধর্মপ্রচারকদের একাংশের অশুভ কর্তৃত্বকারী মানসিকতা, ভারতের সনাতন ধর্ম ও জীবনধারার প্রতি অবজ্ঞা বহু ক্ষেত্রেই এই মহান ধর্মপ্রচারকের জীবনাদর্শ ও নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। তাই মাঝে মধ্যেই উভয় ধর্মের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে, আজও তার বিচ্ছিন্ন প্রকাশ দেখা যায়। অবশ্যই এহেন পরিণতি বাঞ্ছনীয় নয়।
O ভারতে ইসলাম ধর্ম O
সংখ্যার বিচারে ভারতে দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম ইসলাম। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের ভাষায়, “বর্তমানে ভারতের জাতীয় সত্তা এক যৌগিক সত্তা । এই যোগসভার ছোট ছোট অংশীদারদের ছেড়ে দিলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শরিক হচ্ছে হিন্দু ও মুসলমান । এই দুই অংশ ঐক্যবদ্ধ থাকলে ভারতের জাতিসত্তা নিরাপদ, নিশ্চিত। এবং এদের ঐক্যবদ্ধ না থাকার কোন কারণও থাকতে পারে না ।  আচাৰ্য রায় দৃঢ়তার সাথে লিখেছেন, “যে পরিস্থিতি বা কারণে মুসলমানদের ভারতে আগমন ঘটে তা এখন প্রাচীন ইতিহাসের বিষয় । বর্তমানে তঁরা এই মাটিরই সন্তান এবং হিন্দুদের মতই এই ভূমির জন্মগত অধিবাসী । এদের জীবনচর্চা, স্বার্থ ও আশা-আকাঙ্ক্ষা পরস্পরের (হিন্দু-মুসলমান) সঙ্গে শত বন্ধনে জড়িত ।
ইসলাম ধর্মের প্রচারক হজরত মুহাম্মদ(সঃ) । ৫৭০ খ্ৰীষ্টাব্দের ২০/২৯ আগষ্ট আরব দেশের অন্তর্গত দক্ষিণ হেজাজে সভ্রান্ত কোরেশ বংশে  জন্ম হয়। র্তার বাবা ও মা'র নাম যথাক্রমে আবদুল্লাহ ও আমিনা। প্রাকৃতিক দিক থেকে আরবদেশ রুক্ষ প্রকৃতির। এর  অধিকাংশ অঞ্চল শুষ্ক, বালুকাময়, প্রস্তরাকীর্ণ এবং মরুভূমিময়। আরবের মানুষ যাযাবর জীবনযাপন করত। এদের বলা হত বেদুইন। এরা নানা গোষ্ঠীতে বিভক্ত ছিল এবং গোষ্ঠীদ্বন্দু ছিল নিত্যকার ঘটনা। ধর্মের দিক থেকে এরা ছিল পৌত্তলিক ও বহু দেবদেবীতে বিশ্বাসী। তাদের উপাস্য ছিল গাছ, পাথর ইত্যাদি। জন্মের প্রায় চার মাস আগে মহম্মদ পিতৃহারা হন। সম্রান্ত আরব বংশের রীতি অনুযায়ী লালিত হন ধাত্রীমাতা হালিমার গৃহে।নিত্য-জীবনের কঠোর সংগ্রামের মধ্যেও হজরত মুহাম্মদ(সঃ) এর  হৃদয় সৃষ্টিরহস্য জানার আকাঙ্ক্ষায় আকুল হয়ে উঠত। প্রতিবছর প্রায় একমাস হেরা পর্বতের নির্জন গুহায় তিনি প্রার্থনারত থাকতেন। এক মাসের প্রার্থনা শেষ হলে মক্কায় গিয়ে “কাবা’ পরিদর্শন ও প্ৰদক্ষিণ করতেন। এই উপাসনালয়ের প্রতিষ্ঠা ইহুদি, খ্ৰীষ্টান ও মুসলমানদের আদি ধর্মগুরু হজরত ইব্রাহিম থেকে।
৬১০ খ্ৰীষ্টাব্দের রমজান মাসে ‘কোরান” প্রথম অবতীর্ণ হয়। এই সময় হজরত মুহাম্মদ(সঃ) প্রথম ঈশ্বরের প্রত্যাদেশ পান। দেবদূত জিব্রিাইল (আঃ)মুহাম্মদ(সঃ) এর কাছে আল্লাহর আদেশ নিয়ে আসেন। মুসলমানদের বিশ্বাস কোরানের বাণীগুলির ভাব ও ভাষা আল্লাহর সন্নিধান থেকে সমাগত। কোরানের বক্তব্য চিরন্তন এবং অপরিবর্তনীয়। মুসলমানদের আর একটি অতি-আবশ্যিক অনুসরণীয় গ্রন্থ হল ‘হাদীস’ (হাদীছ)। হাদীস প্রসঙ্গে মোহাম্মদ মোকরাম খাঁ মোস্তাফা চরিত’ গ্রন্থে লিখেছেন, “হযরত মোহাম্মদ মোস্তাফা (১) যাহা করিয়াছেন, (২) যাহা বলিয়াছেন এবং (৩) তাহার প্রত্যক্ষ গোচরে যাহা করা বা বলা হইয়াছে অথচ তিনি প্রতিবাদ করেন নাই, মোটের উপর এইরূপ কাজ ও কথার বিবরণের নাম—হাদীছ”।
মৌলিক ইসলাম শাস্ত্র হিসেবে তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ নামটি হল “সুন্ন’ । বস্তুত ইসলাম ধর্মাচারে কোরানের পরেই সুন্নার স্থান। সুন্ন বলতে বোঝায় প্রথা বা নিয়ম। অনুমিত হয় সপ্তম শতকের শেষভাগ ও অষ্টম শতকের গোড়ার দিকে ‘সুন্ন’ সংকলিত হয়। এই পবিত্র ‘সুন্ন’ যারা মেনে চলেন তারা “সুমী’ নামে পরিচিত হন। ইসলামের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হল শরিয়াত’ | একাদশ-দ্বাদশ শতকে শরিয়ত সংকলিত হয়। সুকোমল সেন—পূর্বোক্ত গ্রন্থ, পূঃ ১৫৫ ৷৷
একজন মুসলমানের প্রাত্যহিক জীবনযাপন পদ্ধতির নির্দেশিকা এই গ্রন্থ। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত একজন সৎ মুসলমানের নৈতিকতা, সংসার জীবন, ধমীয় ও সামাজিক আচার-আচরণ, আইন-কানুন ইত্যাদি সবকিছুই শরিয়তে সুনির্দিষ্ট করা আছে।
আল্লাহর প্রত্যাদেশ পেলেও মক্কার মানুষ খুব সহজে তা গ্রহণ করেনি। উপরন্তু প্রচলিত বহীশ্বরবাদ ও পৌত্তলিকতার বিরোধিতা করার জন্য হজরত ও তার সামান্য সংখ্যক অনুগামীর উপর নেমে আসে। চরম হেনস্তা। কোরেশ গোষ্ঠীপতিরা হজরতকে প্রলোভন, ভয় ও নির্যাতন দ্বারা মক্কা থেকে নির্বাসিত করার চেষ্টা চালান। চরম নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে পনেরোজন অনুগামীকে হজরত দেশত্যাগের পরামর্শ দেন। এরা আবিসিনিয়ার খ্ৰীষ্টান রাজা নাগুন-এর কাছে আশ্রয় পান। এটিই মুসলমানদের দেশত্যাগের প্রথম ঘটনা। পরে আরো কিছু মুসলমানকে হজরত দেশের বাইরে গিয়ে জীবন ও আদর্শ রক্ষার পরামর্শ দেন। শেষ পর্যন্ত তিনিও মক্কা ছাড়তে বাধ্য হন। হজরত মক্কা ছেড়ে মদিনায় পৌঁছান ৬২২ খ্ৰীষ্টাব্দের ২৪ সেপ্টেম্বর। এই ঘটনাটি মুসলিম ইতিহাসে হিজরা” নামে অভিহিত হয়। এই দিন থেকে মুসলমানদের স্বতন্ত্র সন, তারিখ গণনা শুরু হয়। একে বলা হয় ‘হিজরা’ সনি।
মদিনায় হজরত স্বাধীনভাবে ইসলাম প্রচার করার সুযোগ পান। ইসলামদের শান্তি, সৌভ্রাতৃত্ব ও সামাজিক সাম্যের বাণী এবং উজ্জ্বল মানবিক মুখ খুব সহজেই মদিনাবাসীর হৃদয় স্পর্শ করে। ধর্মপ্রচারের পাশাপাশি সুপ্রশাসকের ভূমিকা পালন করে হজরত এখানে শক্তি সঞ্চয় করতে সক্ষম হন। অতঃপর তিনি মক্কায় তার উপলব্ধি প্রচারের চেষ্টা চালান। ৬৩০ খ্ৰীষ্টাব্দে দশ হাজার অনুগামীসহ হজরত মক্কায় প্রবেশ করেন। এইভাবে মক্কা ও মদিনায় ইসলামধর্মের ভিত্তি স্থাপিত হয়। পরবতী একশো বছরের মধ্যেই ইসলামধর্মের বিজয় পতাকা বিশ্বের অধিকাংশ দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
ইসলামের অভূতপূর্ব সাফল্য প্রসঙ্গে মানবেন্দ্রনাথ রায় বলেছেন, ‘ইসলামের বিস্ময়কর সাফল্যের কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে প্রধানত এর বৈপ্লবিক তাৎপৰ্য্য এবং গ্রীস, রোমের পাশাপাশি পারসিক, চৈনিক ও ভারতীয় প্রাচীন সভ্যতার অবক্ষয়ের ফলে উদ্ভূত এক হতাশা থেকে জনগণকে মুক্ত করার এক ক্ষমতার মধ্যে৷”! 1) M. N. Roy . Historical Role of Islam, P-6


ইসলামধর্ম এই বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত যে, মানুয্যের অস্তিত্বের মূল উদ্দেশ্য হল সর্বশক্তিমান এবং এক ঈশ্বর আল্লাহর নিকট আত্মসমৰ্পণ ও তীর উপাসনা করা। জীবন খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু এই তাৎপর্যের একমাত্র শর্ত হল। সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের (আল্লাহ) অনুমোদন। ইসলাম ধর্মমতে বিশ্বাস করা হয় যে, জগৎ-সংসার মায়া নয়, জগৎ একটা নির্মম সত্য। এখানে শান্তি ও দুঃখ উভয়েরই অস্তিত্ব আছে। ঈশ্বরের প্রতি আত্মসমর্পণের পথেই দুঃখকে এড়ানো সম্ভব।
পবিত্র কোরানে বলা হয়েছে, “তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তিই আল্লাহর নিকট সর্বাধিক সম্মানিত যে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে আল্লাহ-ভীরু” (আলকোরআন ৪৯:১৩ )
ইসলাম মানবজাতির জন্য কিছু মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করেছে। ইসলামের দৃষ্টিতে ব্যক্তি ও সমাজের কল্যাণ কামনায় যা কিছু করা হয় তাই মঙ্গলজনক এবং যা কিছু ব্যক্তি ও সমাজের চেতনার পরিপন্থী। তাই অমঙ্গলজনক। পবিত্র ধর্মগ্রন্থে মুসলমানদের চারটি নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে- (১) তাদের বিশ্বাস হবে খাঁটি, অকৃত্রিম এবং আন্তরিক, (২) তাদের বিশ্বাসকে সকল মানুষের কল্যাণার্থে নিয়োজিত করতে হবে, (৩) তাদের অবশ্যই সামাজিক সংগঠনের সাহায্যকারী ও সুনাগরিক হতে হবে এবং (৪) সকল অবস্থাতেই তাদের হৃদয় থাকবে স্থির, দৃঢ় এবং অবিচল।

দম্ভ ও অহংকারের বিরোধিতা করে পবিত্র কোরানের বলা হয়েছে “লোকদের দিক হতে মুখ ফিরিয়ে কথা বল না, জমিনের ওপর দিয়ে অহংকার সহযোগে চলাফেরা করো না। আল্লাহু কোন আত্ম-অহংকারী দাক্তিক মানুষকে পছন্দ করেন না” (৩১ঃ ১৮-১৯)।

ইসলাম ধর্মমতে সামাজিক দায়িত্ব পালনের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। মাতা, পিতা, পুত্ৰ-কন্যার পাশাপাশি আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, বন্ধু, সমগ্ৰ মানবজাতি, পশুপাখী ও প্রাণীকুলের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
খ্ৰীষ্টীয় সপ্তম শতকে ইসলাম ধর্মাবলম্বী আরব বণিকরা ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে বসতি স্থাপন করলে ভারতের সাথে ইসলামের পরিচয় ঘটে। ৭১২ খ্ৰীষ্টাব্দে আরব সেনাপতি মহম্মদ ইবন কাশিম সিন্ধুদেশ দখল করে আরব শাসনের সূচনা করলে এদেশে ইসলামের সম্প্রসারণে নতুন গতি আসে। তবে ভারতে আরব শাসনের স্থায়িত্ব ছিল কম। তাছাড়া সিন্ধুর সন্নিহিত অঞ্চলের বাইরে তাদের ক্ষমতা বিস্তারের ইচ্ছাও ছিল না। ত্ৰয়োদশ শতকের সূচনায় তুকীদের নেতৃত্বে দিল্লী সুলতানির প্রতিষ্ঠা ঘটলে ভারতের রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতি এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করে।
****ভারতবর্ষে ইসলামধর্মের প্রসার ঘটেছিল একাধিক কারণে। বহিরাগত যোদ্ধা মুসলমান কিংবা ভারতে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সুলতানগণ দ্বারা হিন্দুদের বলপূর্বক ধর্মান্তরকরণের কথাই সাধারণভাবে মনে আসে। কিন্তু এ-ধারণা সঠিক নয়। গজনীর মামুদ ধর্মপ্রচার করতে ভারত আক্রমণ করেননি। তার প্রধান লক্ষ্য ছিল এ-দেশের সম্পদ লুণ্ঠন করা। অন্য দিকে তুকী সুলতানরা প্রশাসন বা সমাজব্যবস্থার উপর উলেমাদের স্বেচ্ছাচারিতা আন্দেী বরদাস্ত করতেন না।
স্থানীয় ও বিচ্ছিন্নভাবে জোরপূর্বক ধর্মান্তরের কিছু ঘটনা হয়ত ঘটেছিল, তবে তা ব্যাপক আকারে হয়নি। রাজকীয় উদ্যোগে ধর্মান্তরকরণের ঘটনাগুলির পেছনে বিদ্রোহী অ-মুসলমান সামন্তরাজাদের জব্দ করার একটা ইচ্ছা সক্রিয় ছিল। এটাকে এক ধরনের শাস্তি হিসেবেই ব্যবহার করা হত। এমন ঘটনাও ব্যাপক আকারে হয়নি। শাসক শ্রেণীর কৃপাভাজন হওয়ার লক্ষ্যে এবং ব্যক্তিগতভাবে রাজশক্তির অনুগ্রহ লাভের আশায় কেউ কেউ স্বেচ্ছায় ইসলামধর্ম গ্রহণ করেন। আবার কিছু সংখ্যক মানুষ নিছক আদর্শের কারণে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ধর্মান্তর গ্রহণ করেছিলেন। তবে এই দুটি ক্ষেত্রেও সংখ্যার বিচারে ছিল নগণ্য।******** 

@@@@তৎকালীন ভারতের সামাজিক চরিত্র ভারতে ইসলামধর্মের সম্প্রসারণের সহায়ক ছিল। প্রচলিত সামাজিক ভেদাভেদ, উচ্চবর্ণের উৎপীড়ন, স্মৃতিশাস্ত্রসমূহের কঠোর বিধান সাধারণ মানুষের মনে হিন্দুধর্ম ও সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে অনাস্থা ও অসন্তোষ সৃষ্টি করেছিল। এই সকল অবহেলিত ও কোণঠাসা মানুষ স্বেচ্ছায় ইসলামধর্ম গ্রহণ করেন এবং এরাই ভারতীয় মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ। @@@@@@

ইসলামের সাম্যবাদী সমাজচেতনা, সহজ-সরল ধর্মাচার পদ্ধতি অনিবাৰ্য্যভাবেই আকর্ষণ করেছিল প্রচলিত সামাজিক শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে আগ্রহী সাধারণ ভারতবাসীকে। বর্তমান বিশ্বের চারটি বৃহত্তম মুসলিম অধুষিত দেশের একটি হল ভারত। অন্য দুটিও এই উপমহাদেশে অবস্থিত—পাকিস্তান ও বাংলাদেশ। ভারতে ইসলামধর্মের এহেন জনপ্রিয়তা রক্ষণশীল অনেককেই বিস্মিত করেছে।
*এমনও মনে করা হয় যে ইসলামের প্রভাবে ভারতের বিশুদ্ধ হিন্দু সংস্কৃতি “আমোচনীয় এক সংকর সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত হয়েছে।( অমর্ত্য সেন— মুসলিম সমাজ ও এই সময় দ্রষ্টব্য)
এমন ধারণা অমূলক। মনে রাখা দরকার যে প্রাক-মুসলিম ভারতও নিছক হিন্দু ভারত ছিল না। এমনকি, প্রাক-মুসলিম ভারতে বহু অ-হিন্দু রাজার অস্তিত্ব ছিল। সাঙ্গীকরণ ঘটেছিল গ্ৰীক, পারসিক, শক, হ্রণ ইত্যাদি বহু বিদেশী সংস্কৃতির। ভারতের ধর্ম-চিন্তার বিকাশ ও সামাজিক ধারায় ইসলামধর্মের গুরুত্বপূর্ণ স্থান আজ একটি ঐতিহাসিক সত্য।
***সূত্রঃ ভারতে ধর্মচিন্তার ক্রমবিকাশ


Viewing all articles
Browse latest Browse all 15150

Trending Articles