Quantcast
Channel: প্রজন্ম ফোরাম
Viewing all articles
Browse latest Browse all 15150

বৃটিশ-বিরোধী লড়াইয়ে বিস্ময়কর দুই মওলানা

$
0
0

বৃটিশ-বিরোধী লড়াইয়ে বিস্ময়কর দুই মওলানা
১।মওলানা শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী (১৭০৩-১৭৬২)
২।মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধী (১৮৭২-১৯৪৪)

**মওলানা শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী (১৭০৩-১৭৬২)

১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবকে কার্ল মার্কস ভারতবর্ষের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বলেছেন- এ কথা আমরা সকলেই জানি। কিন্তু অনেকেই জানি না, সেই স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম স্বপ্নদ্রষ্টা ও প্রধান রূপকার ছিলেন সিপাহী বিপ্লবের ১শ' বছরেরও অধিককাল আগে উত্তর ভারতে জন্ম নেওয়া এক ক্ষণজন্ম পুরুষ- মওলানা শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী । উপমহাদেশে পরবর্তীকালে স্বাধীনতা আন্দোলনের দুই অগ্রণী নেতা মহাত্মা গান্ধী ও কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যদি হতে পারেন যথাক্রমে ভারত ও পাকিস্তানের ‘জাতির পিতা, তাহলে শাহ ওয়ালীউল্লাহকে বলা যায়— একটি প্রকৃত স্বাধীন ও শ্রেণী:শোষণমুক্ত ভারতবর্ষের প্রথম স্বপ্নদ্রষ্টা।

অথচ আশ্চর্যজনকভাবে বৃটিশ ও ব্রাহ্মণ্যবাদীদের লেখা ইতিহাসে শাহ ওয়ালীউল্লাহর নাম অনেকটাই অনুপস্থিত। থাকলেও তা নিষ্পপ্রভ। দুঃখজনক ব্যাপার হ’ল, বিপুল সংখ্যাগুরু মুসলিম জনগোষ্ঠী আধ্যুষিত দেশ বাংলাদেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করা শিক্ষিত লোকদের প্রায় ৭০ ভাগই- বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের অংকুরোদগমে ও তার উত্থানে শাহ ওয়ালীউল্লাহর অবদান সম্পর্কে শুধু অজ্ঞই নন, বরং তাদের অনেকের কাছে শাহ ওয়ালীউল্লাহ মস্ত বড় একজন ‘মৌলবাদী পাণ্ডা’ ছাড়া আর কিছুই নন।

প্রসঙ্গত বলা দরকার, শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী সম্পর্কে বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের রাজনৈতিক মহলে রয়েছে দুই ধরনের (পরস্পরবিরোধী) মূল্যায়ন। উপমহাদেশের মুসলিম কমিউনিটির আশা-আকাঙ্ক্ষা ও ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে যারা শাহ ওয়ালীউল্লাহকে মূল্যায়ন করেন, তাদের মতে— মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর ভারতবর্ষে ইসলাম যেরকম সঙ্কটাপন্ন পরিস্থিতিতে পতিত হয়েছিল, সেই সঙ্কটের হাত থেকে ইসলামকে রক্ষা করে তাকে নতুন প্ৰাণে উজ্জিবিত করার কাজে মওলানা শাহ ওয়ালীউল্লাহ সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন।

এদের অনেকের মতে, আঠারো শতকের গোড়ার দিকে সদ্য বৃটিশ-দখলকৃত ভারতে মওলানা শাহ ওয়ালীউল্লাহর মত পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলামী চিন্তাবিদের আবির্ভাব না হলে, ভারত উপমহাদেশে আজকে হয়তো ইসলামের অস্তিত্বই থাকতো না।

এ প্রসঙ্গে আমাদের কথা হ’ল, উপমহাদেশের মুসলমানরা ইসলাম যতটুকুই বুঝুকি এবং অসংখ্য ধর্মতান্ত্রিক ফেরকা সৃষ্টি করে নিজেদের মধ্যে দলাদলি, এমনকি হানাহানি-রক্তারক্তি করে ইসলামের মূল নীতিকে যতই ভুলুষ্ঠিত করুক- তবুও বর্তমান বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদী-ইহুদিবাদী-ব্ৰাহ্মণ্যবাদী শক্তি আজ মধ্যপ্ৰাচ্য ও উপমহাদেশসহ সারা বিশ্বে ইসলামকেই গণ্য করে তাদের প্রধান শত্রু হিসেবে।

সুতরাং উপমহাদেশে ও বাংলাদেশে জালিমদের ঘুম হারাম করে আজও মজলুমের পক্ষ নিয়ে টিকে আছে যেটুকু ইসলাম— তার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে মওলানা শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভীর।

পক্ষান্তরে রাজনীতিক মহলে যারা শাহ ওয়ালীউল্লাহকে নেতিবাদী (নিগেটিভ) দৃষ্টিতে মূল্যায়নের প্রয়াস পান— তাদের মতে শাহ ওয়ালীউল্লাহ একজন ‘ধৰ্মীয় মৌলবাদী’ এবং উপমহাদেশের ‘ইসলামী মৌলবাদের’ প্ৰধান গুরু।

এখানে বলে। রাখা দরকার, বৃটিশ ভারতে মওলানা শাহ ওয়ালীউল্লাহ সম্পর্কে এই প্রচারণাটি প্রথম চালায় ইংরেজরা। পরবতীতে তা সংক্রমিত হয় উপমহাদেশের ব্ৰাহ্মণ্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ-প্রভাবিত একশ্রেণীর ‘ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিক-বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে। ভারত ও বাংলাদেশে শাহ ওয়ালীউল্লাহ-বিরোধী প্রচারণায় এই কথিত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী গোষ্ঠীটি খুবই সক্রিয়। বলাবাহুল্য এটা শাহ ওয়ালীউল্লাহর প্রতি কোন ব্যক্তিগত আক্রোশের কারণে নয়, এই সক্রিয়তার কারণ তাদের সামাজ্যবাদ ও ব্রাহ্মণ্যবাদ-প্ৰীতি এবং ইসলাম-বিদ্বেষ।

ইতিহাসে মওলানা শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভীর ভূমিকার যথার্থ মূল্যায়নে যাওয়ার আগে তাঁর মৌলিক রাজনৈতিক দর্শনের ওপর আলোকপাত করা খুবই জরুরী। আমাদের দেশের ইছলামপন্থী রাজনীতিক-বুদ্ধিজীবীরা শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভীকে মূল্যায়নের প্রয়াস পান প্রধানত ধৰ্মতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ দিয়ে, যা শাহ ওয়ালীউল্লাহর জীবন ও কর্মের সামগ্রিক মূল্যায়নের দাবী পূরণ করতে পারে না। গতানুগতিকতার এই সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে বৃহত্তর পরিসরে শাহ ওয়ালীউল্লাহর যথার্থ মূল্যায়ন আজ সময়ের দাবী বলে আমরা মনে করি।
এ বিষয়ে সকল তর্ক-বিতর্কের উর্ধে থেকে অবলীলাক্রমে যা বলা যায় সেটি হ’ল- রাজনৈতিক চিন্তাধারায় শাহ ওয়ালীউল্লাহ একদিকে ছিলেন এক অখণ্ড, স্বাধীন, ঐক্যবদ্ধ ও সমৃদ্ধশালী হিন্দুস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা। আর অন্যদিকে তিনি ছিলেন  শাসক শ্রেণীর স্বেচ্ছাচারিতা, বিলাসিত, অহমিকা, শক্তির দাপট, সকল প্রকারের শোষণ-লুণ্ঠন এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক আপোসহীন জেহাদী।
বলাবাহুল্য শাহ ওয়ালীউল্লাহর আদর্শ ও লক্ষ্যের এই দিকগুলো ইসলামী ঘরানার পণ্ডিত-বুদ্ধিজীবীদের বই-পুস্তক পড়ে পরিষ্কারভাবে জানা যায় না। অন্যদের দারস্থ হতে হয়।
**এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত ভারতীয় লেখক-গবেষক সুরজিৎ দাশগুপ্ত তাঁর ‘ভারতবর্ষ ও ইসলাম” গ্রন্থে শাহ ওয়ালীউল্লাহ সম্পর্কে বলেছেন---ভারতের “ওয়াহাবী আন্দোলনের’ গুরু  মওলানা শাহ ওয়ালীউল্লাহ আসলে ছিলেন মানুষের মধ্যে আদি সাম্যের প্রচারক। ... অর্থনৈতিক বৈষম্যের সমাজে অর্থাৎ যে সমাজ-ব্যবস্থায় জনসাধারণের একটুকরো রুটির জন্য গাধা ও বলদের মত মেহনত করতে হয়, অথচ কিছু লোক না খেটেই সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করে তা উচ্ছেদ করার জন্য ১৭৩১ খৃষ্টাব্দে নাগাদ একটি গোষ্ঠির সৃষ্টি করেছিলেন তিনি।”

মওলানা শাহ ওয়ালীউল্লাহর হাতে গড়া সেই গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতায় ও উত্তর-পশ্চিম ভারতে এবং তার ভাবশিষ্য সৈয়দ নিসার আলী তিতুমীরের নেতৃত্বে বাঙলায়- বৃটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনার পাশাপাশি সমাজে শোষণ-নিপীড়ন ও মানুষে-মানুষে বৈষম্য দূর করার জন্য সামন্তজমিদার-ভূস্বামীদের বিরুদ্ধে (শ্রেণীশক্ৰদের বিরুদ্ধে) যে রক্তক্ষয়ী আন্দোলন লড়াই পরিচালিত হয়, সাধারণ প্রচারণায় তার নাম হয় ‘ওয়াহাবী আন্দোলন’।
কিন্তু বেরেলবী ও তিতুমীরের আন্দোলন-লড়াইয়ের তাত্ত্বিক ও আদর্শিক গুরু মওলানা শাহ ওয়ালীউল্লাহ আরবের ওয়াহাবী আন্দোলনের ধারক বা অনুসারী ছিলেন না। আঠারো শতকের গোড়াতে আরবে ওয়াহাবী আন্দোলনের সূত্রপাত হয় নজদ অঞ্চলের অধিবাসী আব্দুল ওয়াহাবের নেতৃত্বে। প্রসঙ্গত বলা দরকার আব্দুল ওয়াহাব শাহ ওয়ালীউল্লাহর সমসাময়িক ও সমবয়সী হওয়া সত্ত্বেও এবং শাহ ওয়ালীউল্লাহর একাধিকবার মক্কায় গমনাগমন সত্ত্বেও, আব্দুল ওয়াহাবের সঙ্গে শাহ ওয়ালীউল্লাহর কখনই কোন যোগাযোগ ঘটেনি। শাহ ওয়ালীউল্লাহর জীবনীকার সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভীর দেওয়া তথ্য মোতাবেক আব্দুল ওয়াহাবের সঙ্গে মাওলানা শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভীর কখনও সাক্ষাৎ হওয়া তো দূরের কথা, খোদ একজন সম্পর্কে অন্যজনের জানাশোনা হওয়ারও অদ্যাবধি কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।
বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ও গবেষক অধ্যাপক এম. হোসেন, আরবের ওয়াহাবী আন্দোলন থেকে ভারতীয় ওয়াহাবী আন্দোলনের মৌল পার্থক্য নির্ধারণ করেছেন- ১৯৩৯ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি কংগ্রেস-এ উপস্থাপিত ‘ওরিজিন্স অব ওয়াহাবিজম’ শীর্ষক এক গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধে। এ প্রসঙ্গে সুরজিৎ দাশগুপ্ত অধ্যাপক এম. হোসেনের প্রবন্ধের ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন দুটি আন্দোলনের মধ্যে নামের সুস্পষ্ট সাদৃশ্য থাকা সত্ত্বেও ভারতীয় ওয়াহাবী আন্দোলনের প্রকৃত মন্ত্ৰদাতা আরবের আব্দুল ওয়াহাব নন, দিল্লীর মৌলানা শাহ ওয়ালীউল্লাহ। মওলানা শাহ ওয়ালীউল্লাহর ভাবধারায় সৈয়দ আহমদ বেরেলবী  হজ্জযাত্রার আগেই প্রভাবিত হন। কিন্তু পরে বহির্ভারতীয় জগতেরআন্দোলনে  শামিল করে তোলেন ও ওয়াহাবী নামটি ব্যবহার করতে থাকেন।
এ কারণেই বেরেলবী ও তিতুমীরের নেতৃত্বে পরিচালিত বৃটিশবিরোধী ও সামন্তজমিদারবিরোধী আন্দোলন সাধারণভাবে ‘ওয়াহাবী আন্দোলন” নামে প্রচার লাভ করে। কিন্তু আরবের ওয়াহাবী আন্দোলনের মত ভারতীয় ওয়াহাবী আন্দোলন নিছক ধর্মতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, সেটি ছিল শাহ ওয়ালীউল্লাহর রাজনৈতিক চিন্তাধারা ও আদর্শের ভিত্তিতে পরিচালিত, একইসাথে বৃটিশবিরোধী জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম এবং মানুষে-মানুষে বৈষম্য দূর করে সমাজে ইনছাফ প্রতিষ্ঠার জন্য শ্রেণীর মুক্তির সংগ্রাম। আর এই প্রেক্ষাপটেই মওলানা শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভীকে মূল্যায়ন করতে হবে- একদিকে উপমহাদেশে ইছলামের পুনর্জাগরণের অবিসম্বাদিত নেতা হিসেবে, অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম এবং সামন্তজমিদার-ভূস্বামীদের বিরুদ্ধে শ্রেণীর মুক্তির সংগ্রামের রূপকার হিসেবে। ইতিহাসে শাহ ওয়ালীউল্লাহর ভূমিকার যথার্থ মূল্যায়নের এটাই হচ্ছে সঠিক পন্থা।
২। মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধী (১৮৭২-১৯৪৪)
বৃটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের আরেক অবিসম্বাদিত নেতা, কিংবদন্তীতুল্য ব্যক্তিত্ব মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধীর নাম ইতিহাসের পাতা থেকে একরকম মুছে ফেলা হয়েছে। প্রকৃত ইতিহাস চেপে রাখা হয়েছে। বাংলাদেশের আজকের তরুণ প্রজন্মের প্রধান করণীয় হ’ল, বৃটিশ ও ব্রাহ্মণ্যবাদীদের ষড়যন্ত্রে দু'শ' বছর ধরে চেপে রাখা ইতিহাস পুনরুদ্ধার করে তা জাতির সামনে তুলে ধরা।
ইঙ্গ-ব্ৰাহ্মণ্যবাদী ইতিহাসবিদরা তাদের রচিত— ভারতবর্ষের বৃটিশবিরোধী লড়াইয়ের ইতিহাসে মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধীর (সিন্ধু প্রদেশের বাসিন্দা বলে সিন্ধী বলা হয়) যথার্থ স্থান না হলেও ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে হাতেগোণা  যে কয়জন উচ্চতম মর্যাদাসম্পন্ন নেতার নাম প্রকৃত ইতিহাসের পাতায় চিরকাল স্বর্ণীক্ষরে লেখা থাকবে তাদের মধ্যে ওবায়দুল্লাহ সিন্ধীকে অন্যতম না বলে শ্ৰেষ্ঠতম বিলাই বেহতর।
***অনেকেই জানেন না যে, মওলানা সিন্ধী ছিলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর রাজনৈতিক গুরু এবং মওলানা আবুল কালাম আজাদের আদর্শিক গুরু। তাছাড়া সুভাষ বসুকে জাপানে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধী।

**মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধী সম্পর্কে গোলাম আহমাদ মোর্তজা লিখেছেন
ইতিহাসখ্যাত হঠাৎ নেতার দলরা স্বাধীনতা আন্দোলনের শেষে উদিত হয়ে ইংরেজদের সাথে লড়াই না করে হিন্দু-মুসলমানের লড়াই করেছেন, আর শাসক ইংরেজ হাসি চাপা রেখে গভীর মুখে ঐ মারামারিকে স্বাধীনতা যুদ্ধ, আর মোড়লদের যোদ্ধা বলে “টাইটেল’ দিয়েছেন। সুভাষ বসুকে কং দলে গ্রহণ না করার শ্রেষ্ঠ কারণ হচ্ছে এই, তিনি মুসলমানদের আন্দোলনের ফর্মুলা গ্ৰহণ করেছিলেন। আর তাঁর রাজনৈতিক গুরু ছিলেন মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধী। বৃটিশ সরকার যখন বুঝতে পারল যে উনি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ যেখানে থাকবেন সেখানেই বিপ্লবের আগুন জ্বলে উঠবে- তখন তাঁর ওপর আইনের আদেশ চাপানো হলো যে, তাকে চিরদিন ভারতবর্ষে প্রবেশ করা চলবে না। বাধ্য হয়েই তাকে ভারতবর্ষ ছেড়ে যেতে হয়। কিন্তু ইংরেজ যদি- ভারতের বাইরে তিনি কতটা সংগঠন ও বিপ্লবীদের সাহায্য এবং ভারত ত্যাগী মুজাহিদদের পথ চলার পাথেয় পরিবেশনা করতে করতে পারেন চিন্তা করত ,তবে তাকে ভারতেই আটকে রেখে বরং বহিভারতে যাতায়াত বন্ধ করে দিত।” **জনাব মোর্তজা অতঃপর লিখেছেন--
মওলানা উবাইদুল্লাহ বৃদ্ধ বয়সে দেশে আসার অনুমতি পান। প্রথমেই তিনি আসেন ভারতের মস্তক বঙ্গে- কলকাতায় । ওখানে আলেমদের জমিয়তে উলামায়ের অধিবেশন। নেতাজী সুভাষ বসু আগে হতেই তাঁর যোগ্যতা, দৃঢ়তা ও ভারতপ্রেমের কথা জানতেন, কিন্তু শিষ্য হওয়ার মতো, বিশেষভাবে পরামর্শ করার মতো সুযোগ পাননি। সুভাষ এবার মওলানার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন, তার পরামর্শ চাইলেন এবং তার কাছে আত্মসমর্পণ করতে চাইলেন। তিনি (সুভাষ) জানালেন, ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতায় তিনি বিশ্বাসী এবং ভারতের জন্য জীবন দিতে তিনিও প্ৰস্তুত।
মওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধী তাঁকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন এবং আস্তে আস্তে বললেন, “আজ রাত্ৰে তৈয়ব ভাই জরিফের বাড়ীতে গোপন আলোচনা হবে । রাত্ৰিতে গোপন কথা হয়েছিল। সেখানে ছিলেন চৌধুরী আশরাফুদ্দিন আর বর্ধমানের মাওলানা আবুল হায়াত প্রমুখ বিখ্যাত প্রকৃত নেতা।
ওখানে উবাইদুল্লাহ সিন্ধী সুভাষ বসুকে আদেশ করেন, “অত্যন্ত চুপিচুপি তুমি **মাওলানা জিয়াউদ্দীন **নাম নিয়ে ১৭ জানুয়ারী (১৯৪১) রওনা হও”।
তারপর মওলানা উবাইদুল্লাহ সাহেব নিজের হাতে অনেক চিঠিপত্র লিখে দিলেন এবং জানালেন, কোন জায়গায়, কোথায়, কী নামে, কী বেশে, কী পদে, কোন রাষ্ট্রে তার শিষ্য-ভক্ত কমীরা আছেন। হয়েছিলও তাই।”


বাস্তবেও দেখা যায়, সুভাষ বসু তাঁর গুরু, মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধীর একান্ত অনুগত শিষ্য হিসেবে ভারতের মুসলিম বিপ্লবীদের মতো ইংরেজদের বিরুদ্ধে পূর্ণ স্বাধীনতার লড়াইকেই আমৃত্যু অনুসরণ করেছেন। দেখা যায়, সুভাষ বসুর আযাদ-হিন্দ ফৌজের উচ্চপর্যায়ের নেতাদের অধিকাংশই ছিলেন মুসলমান। যেমন ক্যাপ্টেন শাহনাওয়াজ, ক্যাপ্টেন বুরহানুদ্দিন, ক্যাপ্টেন আবদুর রশীদ এবং জমাদার ফতেহ খান প্রমুখ।

মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধী বৃটিশবিরোধী স্বাধীনতার লড়াইয়ে তাঁর পরিকল্পনা ও প্রস্তাব সুভাষ বসুকেও দিয়েছিলেন, কংগ্রেসকেও দিয়েছিলেন। কংগ্রেস নেতা গান্ধীজি তা অস্বীকার করেছিলেন, আর সুভাষ বসু মৃত্যু পর্যন্ত তা পালন করেছিলেন। ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠতম বিপ্লবী অশীতিপর বৃদ্ধ এই মওলানাকে বৃটিশরা গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠায় এবং সেখানেই কাপুরুষোচিতভাবে বিষপ্রয়োগে তাঁকে হত্যা করে। এটি ছিল বিশ্বের ইতিহাসে নিকৃষ্টতম কাপুরুষোচিত হত্যাকাণ্ডের একটি।

নেতাজি সুভাষ বসুর ওপর মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধীর প্রভাবের বিষয়ে এবং বিপ্লবী ওবায়দুল্লাহ সিন্ধী সম্পর্কে মওলানা আবুল কালাম আজাদ তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু মওলানা জহীরুল হককে যে পত্র লিখেছিলেন তার বাঙলা তর্জমার কিছু অংশ গোলাম আহমাদ মোর্তজার ‘ইতিহাসের ইতিহাস’ গ্রন্থের বরাতে এখানে তুলে ধরা হ’ল-
দিল্লি ১৫ই সেপ্টেম্বর, ১৯৪৭
স্নেহের মৌলুবী জহীরুল হক (দ্বানপুরী) আছছালামুআলাইকুম আ রহমতুল্লাহ আযাদী উপলক্ষে আপনার প্রেরিত পত্রের জন্য শুভেচ্ছা জানাই। পত্র পড়ে স্মৃতিপটে ভাসে শুধুই মাওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধীর (র.) স্মৃতি। সেই ঘটনা অনেক লম্বা, সংক্ষেপ করলেও যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন। ১৯১৪ সালে বিশ্বযুদ্ধের সময় শাহ ওয়ালীউল্লাহর (র.) কাফেলার নেতা। হযরত মাওলানা মাহমুদুল হাসান (র.) অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতিতে মাওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধীকে কাবুল প্রেরণ করেন। সেখানে মাওলানা উবাইদুল্লাহ বিভিন্ন রাষ্ট্রের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি করেন। তন্মধ্যে জার্মান, ফ্রান্স ও জাপানের এমন সব নেতা-কর্মী ছিলেন, যারা পরবর্তীকালে শাসনক্ষমতার উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন।
পচিশ বছর নির্বাসন ভোগ করে ১৯৩৯ সালে তিনি যখন দেশে আসেন। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। তিনি তাঁর নিজস্ব পরিকল্পনা কংগ্রেসের কাছে পেশ করে সর্বভারতীয় সংগ্রামের প্রোগ্রাম রচনা করেন, সেই সময় গান্ধীজি পর্যন্ত ঐ পরিকল্পনার বিরোধিতা করেন। তাহলেও “ভারত ছাড়’ আন্দোলনটুকু অনুমোদন লাভ করে। একদিন চায়ের মজলিশে তাঁর (উবাইদুল্লাহ সিন্ধীর) সঙ্গে আমার আলাপ হয়। তাঁর চোখ ও চেহারায় চিন্তার চিহ্ন দেখে আমার মনে অনুসন্ধিৎসুর প্রশ্ন জাগে। আমি প্রশ্ন করতেই কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে তিনি তাঁর বাসা উখলায় ফিরে যান।
>>দ্বিতীয় দফায় উখলা হতে দিল্লি পর্যন্ত আট মাইল সড়কের কোন একটি জনমানবশূন্য স্থানে তাঁর সঙ্গে সুভাষের সাক্ষাৎ সংঘটিত হয়। তার পরের সাক্ষাৎটি হয়েছিল কলকাতার বালিগঞ্জ এলাকায়। এইখানে তিনি সুভাষকে জাপান যাত্রার জন্য রওনা করান। জাপান সরকারের নামে একটি ব্যক্তিগত বিশেষ বার্তাও পাঠান। তাই সুভাষ সেখানে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে জাপান সরকারের সৈন্য বিভাগও তাঁর প্রতি আস্থা স্থাপন করতে পেরেছিল।<<
শেষ পর্যন্ত ভয়ংকর বিষ প্রয়োগ করে মাওলানা সাহেবের জীবন শেষ করা হয়। ১৯৪৪ সালের ২২শে আগস্ট তিনি মহামিলনে শামিল হলেন মহান মাওলা স্রষ্টার সঙ্গে। সেদিন আকাশ হতে অশ্রু ঝরেছিল। সারা পৃথিবী শোকে মুহ্যমান হয়েছিল। ভারত সরকার এ সংবাদ গোপন রেখেছিল। ...
অবশেষে সাধারণের ধারণা সত্য বলে প্রমাণিত হয়। ১৯৪৫ সালে পুরো একবছর নয়দিন পর সরকারীভাবে স্বীকার করা হয় মাওলানা সাহেব নিহত হয়েছেন। বাস্তবিক এমন একজন বিপ্লবীকে ওজনের তুলাদণ্ডে এক পাল্লায় রেখে অন্য পাল্লায় সারা পৃথিবী চাপালেও এই বিপ্লবীর সমান হয় না। এখন রয়ে গেছে তাঁর অপরূপ স্মৃতি ও অপূর্ব বিরহ-বেদনা। দুঃখ শুধু এজন্য নয়। যে, তিনি চলে গেছেন। এজন্য দুঃখ যে, তিনি এ জগতের মানুষ ছিলেন তা আজ প্রায় অবলুপ্ত। আমরা সেই দলেরই পশ্চাৎবতীর্ণ কমী, সেই কাফেলার অনুরূপ দল আর পাইনা, আর পাচ্ছিনা গন্তব্যস্থলের ঠিকানা। আমাদের কেউ চিনে না, আর অন্যদেরও আমরা চিনতে পারছি না। সেই শহীদদের উপর স্বাধীনতার গৌরব অৰ্পিত হউক ।
আলহামদুলিল্লাহ (আল্লাহর প্রশংসা)। আমি সুস্থই আছি। আপনার কুশল জানাবেন। আপনার সম্মানিয়া মাতার প্রতি রইলো আন্তরিক সালাম ।
ইতি
   আবুল কালাম *


এই পত্রের মাধ্যমে পরিষ্কার বোঝা যায়- মওলানা আবুল কালাম আজাদ তাঁর মতাদর্শিক গুরু মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধীর প্রতি এতটাই গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করেছেন এবং তাকে এমন উচ্চতম মর্যাদার আসনে স্থান দিয়েছেন, যা তিনি তাঁর রাজনৈতিক গুরু মহার্তা গান্ধীকেও কখনও দেননি।
**ভারত ও বাংলাদেশের কথিত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু এবং মৌলানা আবুল কালাম আজাদের প্রতি শ্রদ্ধানিবেদন করেন। খুবই একপেশে দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে। সুভাষ বসুর প্রতি তাঁরা শ্রদ্ধাপ্রদর্শন করেন। একজন ‘বামপন্থী সমাজতন্ত্রী সুভাষ বসু হিসেবে। আর মৌলানা আবুল কালাম আজাদের প্রতি তারা শ্রদ্ধাপ্রদর্শন করেন। শুধু গান্ধীর ভাবশিষ্য ও কংগ্রেস নেতা হিসেবে। মওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধীর সাথে সুভাষ বসু ও আবুল কালাম আজাদের ঘনিষ্ঠ গুরু-শিষ্য সম্পর্কের কথা কথিত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা কখনই মুখে আনেন না। কারণ ওর মধ্যে তারা ‘মৌলবাদের’ গন্ধ পান। দুঃখজনক ব্যাপার হ’ল, স্বাধীনতার জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ আত্মোৎসর্গকারী এবং সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী মহান বিপ্লবী উবাইদুল্লাহ সিন্ধীর নাম বৃটিশ ও ব্রাহ্মণ্যবাদীদের চক্রান্তে ইতিহাসের পাতায় প্রায় অনুপস্থিত। বাংলাদেশ ও উপমহাদেশের মুসলমানদের বহু গৌরবময় ইতিহাস এইভাবেই ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে।
**বইঃ আত্মবিস্মৃত বাঙালী – ইঙ্গ- ব্রাক্ষণ্যবাদ ও বাঙালীর ভাগ্য বিপর্যয়ের পর্যালচনা
**লেখকঃ রইসউদ্দিন আরিফ


Viewing all articles
Browse latest Browse all 15150

Trending Articles



<script src="https://jsc.adskeeper.com/r/s/rssing.com.1596347.js" async> </script>