‘পরিবার-পরিকল্পনা দেশ ও জনগণকে ক্ষমতায়ন করে’ এমন একটি প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে উদযাপিত হতে যাচ্ছে ১১ জুলাই, ২০১৭ বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। জনমিতির সূক্ষ্ম হিসাবে বর্তমানে বিশ্বে প্রতি ১৪ মাসে প্রায় ১০ কোটি লোক বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং তার সিংহভাগই হচ্ছে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে। এবারের বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে জাতিসংঘ আয়োজিত পরিবার-পরিকল্পনা সামিট, যার নাম হচ্ছে ‘পরিবার-পরিকল্পনা ২০২০-উদ্যোগ’ এবং এর লক্ষ্য হচ্ছে ১২ কোটি অতিরিক্ত নারীকে ২০২০ সালের মধ্যে স্বতঃপ্রবৃত্তভাবে পরিবার-পরিকল্পনার আওতায় নিয়ে আসা। স্বপ্রণোদিত হয়ে নিরাপদভাবে পরিবার-পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণ হচ্ছে মানবাধিকারের অংশ। এ হচ্ছে নারীদের ক্ষমতায়ন এবং লিঙ্গভিত্তিক সমতার নিদর্শন, যা দারিদ্র্যবিমোচনের অন্যতম সহায়ক শক্তি। বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস মোটামুটি ৫টি মুখ্য বিষয়কে বিবেচনা করেই উদযাপিত হয় - সক্ষম দম্পতিদের পরিবার-পরিকল্পনার পদ্ধতি গ্রহণের জন্য প্রচার ও প্রসার, লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণ, দারিদ্র্যবিমোচন, মা ও শিশুস্বাস্থ্য সংরক্ষণ এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ। এই মৌলিক বিষয়গুলোকে দেশ ও জনগণের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করে বিশ্বব্যাপী সক্ষম এবং দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টির মাধ্যমে কল্যাণমুখী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনেই প্রতিবছর বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস উদ্যাপন করা হয়। মূলত ছেলে এবং মেয়ে সব শ্রেণির যুবশক্তিকে ক্ষমতায়ন এবং নিরাপত্তাদানের লক্ষ্যই হচ্ছে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসের অন্যতম ভাবনা। মনে রাখতে হবে, জনগণকে ক্ষমতায়নের অর্থ শুধু আর্থিক বা সামাজিকভাবে সচ্ছল করা নয়। তাদের জীবনের পাঁচটি বিশেষ স্তরে যেমন: প্রসবপূর্ব সময়ে, শিশুকালে, বাল্যকালে, কৈশোরে এবং প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও মানসিক, শারীরিক ও সামাজিক জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার সুযোগ সৃষ্টি করাই এর প্রধান লক্ষ্য। তাই পরিবার-পরিকল্পনার মাধ্যমে ক্ষমতায়নের প্রচেষ্টা শুধু একটি ধারণা নয়, এ হচ্ছে একটি জীবনদর্শন। পরিবার-পরিকল্পনার উদ্দেশ্য হচ্ছে, একটি সক্ষম দম্পতিকে পরিবারের সন্তান ধারণ নির্ধারণের অধিকার প্রদান করা। বাংলাদেশে ১৯৬৪ সালে পরিবার-পরিকল্পনা বোর্ড সৃষ্টির শুরু থেকেই পরিবারের সন্তানের সংখ্যা সম্পর্কে দম্পতির স্বাধীন ভাবনার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয়েছে। এ কারণে বিশ্বে বাংলাদেশের পরিবার-পরিকল্পনা পদ্ধতি একটি সফল কর্মসূচি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এ দেশে মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা ব্যাপকভাবে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরিবার-পরিকল্পনার সুফল সম্পর্কে অবহিত ও উদ্বুদ্ধকরণের কর্মকান্ড পরিচালনা করেছে সঠিকভাবে। এই আচরণ পরিবর্তনের কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছে সমাজের জনপ্রতিনিধিদের এবং ধর্মীয় বিশ্বাসভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে। বাংলাদেশ সহস্রাব্দের উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে সাফল্য প্রদর্শন করে বিশ্বকে চমক দিয়েছে। এখন বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন। এসডিজির লক্ষ্য ৩.৭-এর মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা সর্বজনীন করতে হবে এবং পরিবার-পরিকল্পনা, তথ্য, শিক্ষা ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে জাতীয় কৌশলপত্র প্রণয়ন এবং কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। এসডিজি-২০৩০-এর মধ্যে কিছু সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যও নির্ধারণ করা হয়েছে, যেমন প্রত্যেক দেশকে মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি লাখে ৭০-এর নিচে নামিয়ে আনতে হবে এবং নবজাতকের মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ১২-তে হ্রাস করতে হবে আর ৫ বছরের নিচে শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ২৫-এর নিচে নামিয়ে আনতে হবে। এসব লক্ষ্য অর্জন করতে হলে প্রয়োজন সমন্বিত বহুমুখী কর্মসূচি, যার লক্ষ্য থাকবে জনগণকে ক্ষমতায়ন করা, সামাজিক মূলধন সৃষ্টি করে জনগণের জীবন পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন সাধন করা। পাশাপাশি উগ্রবাদ, সহিংসতা এবং অসহিষ্ণুতা নিবারণের লক্ষ্যকে সামনে রেখে দেশের জনগণের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি ও মানবসম্পদ উন্নয়নের প্রয়োজনে জনগণকে পরিকল্পিত পরিবার গঠনে প্রস্তুত করতে হবে এবং দেশকে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম করার লক্ষ্যে সরকার ও জনগণকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। পরিবার-পরিকল্পনা হবে সহায়ক শক্তি।
↧