উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এমডিজির যুগে (২০০০-২০১৫) বাংলাদেশ দারিদ্র্য দূরীকরণ ও মানব উন্নয়নে অসামান্য সফলতা অর্জন করেছে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এমন সফলতা অনেক পর্যবেক্ষকের কাছেই অবিশ্বাস্য চমক বলে মনে হচ্ছে। কারণ, জাতি হিসেবে আমরা অনেক গুরুতর প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন। প্রতিবন্ধকতাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা, ক্রমবর্ধমান সহিংসতা, পরিবেশ বিপর্যয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সম্পদের স্বল্পতা, আয় ও সুযোগের বৈষম্য, ভঙ্গুর প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়ন ইত্যাদি। এসব প্রতিবন্ধকতা ও ঝুঁকি সত্ত্বেও গত দেড় দশকে বাংলাদেশের জনগণের জীবন-জীবিকায় ব্যাপক অগ্রগতি ঘটেছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, বিশেষত আমাদের উচ্চ প্রবৃদ্ধির হারের একটি বড় কারণ হলো গত কয়েক দশকে তৈরি পোশাকশিল্পে আমাদের ব্যাপক সফলতা। স্বল্প আয় করলেও তৈরি পোশাকশিল্পের সঙ্গে যুক্ত প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক, যাঁদের অধিকাংশই নারী, গ্রামে-গঞ্জে বসবাস করা, তাঁদের পরিবারের আর্থিক সংগতি অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বিদেশে কর্মরত ও হাড়ভাঙা খাটুনিতে নিয়োজিত প্রায় এক কোটি শ্রমিকের পাঠানো অর্থ বাংলাদেশের পল্লি অর্থনীতিতে ব্যাপক গতিশীলতা এনেছে। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর (এনজিও) সচেতনতামূলক কার্যক্রম এবং তাদের উদ্ভাবিত জনগণের বহু সমস্যার স্বল্প খরচের সৃজনশীল স্থানীয় সমাধানই গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের সামাজিক ও মানব উন্নয়নের ক্ষেত্রে অগ্রগতির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। বাংলাদেশে বহু সেবা প্রদানকারী এনজিও সমন্বিতভাবে দরিদ্র মানুষকে টার্গেট করে বহু সেবা দিয়ে আসছে, যাতে তাদের অবস্থা ও অবস্থানের পরিবর্তন হয়। উদাহরণস্বরূপ, গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে এনজিওদের সচেতনতামূলক কার্যক্রম এবং একই সঙ্গে ডায়রিয়া রোগে মৃত্যু রোধে খাবার স্যালাইন (ওআরটি) ও কৃমি রোধের ক্যাম্পেইন, টিকাদান কর্মসূচির সম্প্রসারণ এবং ইউনিসেফের সুপারিশকৃত ব্যয়বহুল পদ্ধতির পরিবর্তে রিং-স্লাব দিয়ে স্বল্প খরচের স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহারের কারণে। সেবা প্রদান করতে গিয়ে এনজিওগুলো নারী ও তাঁদের পরিবারগুলোকে তাদের নিজস্ব স্বার্থসংশ্লিষ্ট অগ্রাধিকারগুলোর ওপর—যেমন পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণ এবং সন্তানদের স্কুলে প্রেরণ ইত্যাদির ওপর জোর দিয়েছে। এ ধরনের কার্যক্রম ও উদ্যোগগুলো জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ এবং মাতৃমৃত্যুর হার কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। মাতৃমৃত্যু রোধে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে নারীদের জন্য সন্তান জন্ম পূর্ব-প্রসূতিসেবা বা ‘প্রি-নেটাল কেয়ার’ এবং সম্ভাব্য ঝুঁকিপূর্ণ নারীদের প্রসব-পূর্ব থেকে চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ। সরকারের পক্ষ থেকে এনজিওগুলোকে সেবা প্রদানমূলক কার্যক্রমে অংশগ্রহণের সুযোগ প্রদান না করা হলে অবশ্য এসব অর্জন সম্ভব হতো না। সরকারের প্রধান লক্ষ্য হল কেউ যেন বাদ না পড়ে এবং সবচেয়ে দরিদ্রতম ব্যক্তিও যেন এতে অন্তর্ভুক্ত হয়, যা অর্জনের মাধ্যমে আরও অনেক দুরূহ প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠবে সরকার। এভাবেই উন্নয়নে ক্রমাগত চমক দেখিয়ে এসডিজি যুগে প্রবেশ করছে বাংলাদেশ।
↧