যেলড্রিয়ান প্রহেলিকা পর্ব-১
যেলড্রিয়ান প্রহেলিকা পর্ব-২
যেলড্রিয়ান প্রহেলিকা পর্ব-৩
যেলড্রিয়ান প্রহেলিকা পর্ব-৪
যেলড্রিয়ান প্রহেলিকা পর্ব-৫
যেলড্রিয়ান প্রহেলিকা পর্ব-৬
আগের পর্বের শেষের কিছু অংশ...
ওদিকে সিমিত কাজে লেগে পড়ে। নিজের নির্বুদ্ধিতায় হাত কামড়াতে থাকে। রেন –এ আভিযানের আগে একবার ন্যানমেকা-চেক করে নেয়া উচিত ছিলো। আসলে চিন্তাও করতে পারে নি – উচ্চ-যেলডিরা এত তাড়াতাড়ি টের পেয়ে যাবে! শত্রুর ক্ষমতাকে কোনো অবস্থায়ই খাটো করে দেখার অবকাশ নেই! অতি সাবধানে ন্যানমেকাটাকে সরাতে সরাতে ভাবতে থাকে সিমিত! নুয়ানের মত সে-ও খানিকটা উত্তেজিত...ফ্যারিহাড সম্ভবত এমন জায়গায় ওদের নিয়ে যাবেন, সেখানে সিমিত কখনোই যায় নি। স্বয়ং ফ্যারিহাডকেও কি দেখা যাবে? এমনি অনেক প্রশ্ন মাথায় ঘুরতে থাকে।
==========================================================================
১০১২ যেলড
হিলড্রা, উচ্চ-যেলড্রন
তথ্যের লাইভ-ফিডটা হঠাত করেই বন্ধ হয়ে গেলো। ইউয়ান কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন। এমনটা হওয়ার কথা না! যে ন্যানমেকটাকে অনুসরণের কাজে পাঠানো হয়েছে, সেটা সর্বাধুনিক টাইপ-৫ সংস্করণের। অতিমাত্রায় নিষ্ক্রিয় থেকে গোপনে কাজ করাটা এটার একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য – এতটাই যে এই যেলড্রিয়ান বিশ্বে কারোরি সেটা ধরতে পারার কথা না। কিন্তু ধারণাটা যে মারাত্মক ভুল, সেটা তো দেখাই যাচ্ছে! ইলেভা-২ –এ সাংঘাতিক কিছু একটা ঘটেছে।
ইউয়ান জরুরী ভিত্তিতে হেসলান হেরিংকে তলব করেন। হেসলান তলবের মাত্রা বুঝে একপ্রকার হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে। গভীর চিন্তায় ডুবে রয়েছেন ইউয়ান – হেসলানের আগমন খেয়ালই করলেন না। হেসলান একটু কেশে শুকিয়ে যাওয়া গলাটা পরিষ্কার করে নেয়।
ইউয়ান! আপনি আমাকে ডেকেছেন? কী ব্যাপার?
চিন্তায় ছেদ পড়ে যায়। হেসলানের দিকে ফিরে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন ইউয়ান। তারপর কিছুটা অপরিচিত গলায়, ‘তুমি সম্ভবত আমাকে পছন্দ করো না। কিন্তু এখন যে কাজটা করতে দিবো, তাতে তোমার ধারণা পাল্টালেও পাল্টাতে পারে’ একধরণের কৌতুকবিহীন হাসি হাসতে থাকেন।
মাফ করবেন, ঠিক বুঝলাম না কী বলতে চাচ্ছেন?
বুঝলে না? ঠিক আছে। কাজের কথায় আসা যাক। টাইপ-৫ ন্যানমেক কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে! রেন সমুদ্রের ইলেভা-২ স্তরে যে রেন-পোর্টারটা গেছে, সেটা থেকে এই ট্রাকিং মেকা অপসারণ এক প্রকার অসম্ভব! নুয়ানের টীম ন্যানমেকা-চেক করলেও কোনোভাবে এটা ধরতে পারতো না। যদি না কেউ...
...বিশেষ কেউ এটাকে শনাক্ত করে ঐ নিম্ন-যেলডিদের জানায়। বাকীটা শেষ করে সন্দেহ বাতিকগ্রস্থ হেসলান।
ঠিক তাই! এখন প্রশ্ন হচ্ছেঃ সেই ‘বিশেষ কেউ’ টা কে? সে আর যাই হোক, আমাদের উচ্চ-যেলড্রিয়ান প্রযুক্তিকে চ্যালেঞ্জের সামর্থ রাখে। এই যেলড্রনে কে এই ক্ষমতা রাখে বলে মনে করো?
ফে...ফেরিন ফ্যারিহাড না তো আবার! হেসলানকে নার্ভাস দেখায়।
ঠিক তাই! ফ্যারিহাডই সম্ভবত... হেসলান, এটা একটা মহা সুযোগ – ফ্যারিহাডকে ধরার একটা যথার্থ উপলক্ষ্য! রেন-ফ্লীট প্রস্তুত করো; চষে ফেলো গোটা ইলেভা-২। তোমাকে সর্বোচ্চ ক্ষমতা দেয়া গেলো।
নিজের কানকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না হেসলান। যে লোক দায়িত্ব নেবার পর থেকেই ফ্যারিহাড-অনুসন্ধান প্রায় মরে যাবার উপক্রম হয়েছিলো, সে কিনা যেচে এই কথা বলছে! ভুল অনুমান করেন নি ইউয়ান ইয়েরিন! হেসলান আসলেই খুশী হয়ে যায়।
আর ঐ নুয়ান –এর কী হবে? হেসলান জিজ্ঞাসা করে।
এই ছেলেটা এই বয়সে যা করেছে, সেটা যথেষ্ট উদ্বেগজনক। সে একটা মারাত্মক মাথাব্যথা! ব্যথা সারাতে যা যা দরকার সবই করবে। কীভাবে করবে, সেটাও কি বলে দিতে হবে?
না তার দরকার হবে না! ক্রুর হাসি হাসতে থাকে নিরাপত্তা প্রধান হেসলান হেরিং।
পরবর্তী ঘন্টাখানেকের মধ্যে বিশাল উচ্চ-যেলড্রিয়ান রেন-পোর্টারের বহর রেন সমুদ্রের ইলেভা-২ স্তরের একটা বিশেষ এলাকার দিকে যাত্রা শুরু করলো।
ইলেভা-২, রেন সমদ্র
নুয়ান ঠিক নিশ্চিত নয় কাপ্পা-নেটে তার উপস্থিতি কতটুকু উন্মোচিত হয়েছে। সে দ্রুত তার বিশেষায়িত যাই-নেটে ঢুকে নিরাপত্তার ফাঁক-ফোঁকরগুলো যাচাই করতে থাকে এবং আবিষ্কার করে ফেলে ক’বে তাকে ট্রেস করা হয়েছে। সিমিতের অনুরোধে নিজের সত্তা যাচাই করে এতটাই উত্তেজিত ছিলো যে নিজের সতর্কতার সমস্ত ধাপ স্রেফ উপেক্ষা করে ফ্যারিহাড্রিয়ান স্থাপনায় চোরা-অনুসন্ধান করে ফেলেছিলো এবং এটাই অচেনা একটা উচ্চ-যেলড্রিয়ান ফাঁদ ব্যবস্থাকে সুযোগ পাইয়ে দেয়। নিজের আহাম্মকির জন্য নিচুস্বরে নিজেকেই একটা অশ্রাব্য গালি দেয়। কীভাবে এই দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজটা সে করতে পারলো?
চিন্তার জাল ছিঁড়ে যায় ইলেভা-২ –এ ল্যাণ্ডকৃত জায়গাটির আশেপাশে একটা অদ্ভুত পরিবর্তনে। রেন-পোর্টারের স্বচ্ছ নৃসিয়াম দেয়াল ভেদ করে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছেঃ রেন –এর একটা বিশেষ অন্তস্রোত গাঢ় সবুজ বর্ণ ধারণ করেছে – অনেকটা পীত রং –এর। সেটার গতি অন্যান্য বিশৃংখল গতি থেকে ভিন্ন – যেন একটা দিক নির্দেশ করছে। রেনরা কি কিছু বলতে চাচ্ছে?
নুয়ান রেন-পোর্টারের ইঙ্গিত-ভাষা (সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ) উদঘাটক মড্যুলটিকে চালু করে দেয়। ঠিকই ধরেছে – রেনরা ওদের দেখানো পথে যেতে বলছে। ফ্যারিহাডও তো এমপ্যাথিক চ্যানেলে এমন কিছু একটা অনুসরণ করার কথা বলেছিলেন। নুয়ান উত্তেজনায় টানটান হয়ে যায়।
সিমিত, ব্যাপারটা কি খেয়াল করেছো?
হু, আমাদের এখনি যাত্রা করা উচিত।
তাহলে দেরী কেন? যাওয়া যাক। সময় বেশি নেই; উচ্চ-যেলড্রিয়ান রেন-পোর্টারের বহর এদিকেই রওনা দিয়েছে। তারা আমাদের অবস্থান জানে!
সিমিত ঝটপট রেন-পোর্টারটাকে চালু করে পীতাভ রেন-স্রোতটাকে অনুসরণ করতে থাকে। দ্রুত গতি বাড়িয়ে দিয়ে রেন –এর স্ট্রীমলাইন বরাবর প্রতিস্থাপন করে আচমকা গতি কমিয়ে আনে। গতির আকস্মিক পরিবর্তনে জড়তার কারণে নুয়ান ঝুঁকে পড়ে আবারও সিমিতকে প্রায় জাপটে ধরে ফেলে। নুয়ান স্পষ্টত বিব্রত হয়ে যায়।
দুঃখিত, মেকা-প্রাণ! আমার করার কিছু ছিলো না। কৈফিয়তের ভঙ্গীতে নুয়ান বলে।
কী করার ছিলো না, মেকা-প্রাণ? শেষের শব্দটা একটু জোর দিয়েই বলে সিমিত। টোনটা একটু যেন টিজ করার মত। সাথে একটা নীচুস্বরের হাসি। কে যে কার সাথে ফ্লার্ট করছে, বোঝা শক্ত!
আ...আ...আমি...বাদ দাও। ভুলে যাও কী বলেছিলাম। বলেই একটা অদ্ভুত কাণ্ড করে বসে নুয়ান। হঠাত সামনের অসামান্য আবেদনময়ী নারীটি বাহুবন্দী হয়ে যায়। একটা উদ্গ্র বাসনা রেশমের অরণ্য ভেদ করে কাঁধের ঢালু উপত্যকায় দাঁড়িয়ে পড়া রোমগুলিকে আদরে আদরে সিক্ত করে দিতে থাকে। কোনো কথা হয় না; সময় যেন জমাট নিস্তব্ধতা হয়ে ঝুলে থাকে!
আহেম...দুঃখিত, তোমাদের বিরক্ত করে ফেললাম সম্ভবত! তোমরা দু’জন মনে হচ্ছে বেশ কাছাকাছি চলে এসেছো? একটা ভারী এমপ্যাথিক কৌতুকপূর্ন কণ্ঠ দু’জনই শুনতে পায়। কণ্ঠটা ফ্যারিহাডের।
নুয়ান সিমিত বাস্তবে ফিরে আসে। ছিটকে সরে এসে অপ্রস্তুত হয়ে যায়।
না, না আপনি যা ভাবছেন, তা নয়! উভয়েই একসাথে বলে ওঠে।
অ, তাই নাকি? (চাপা হাসি) সে যাক। তোমাদের একটা লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে। এটা বিরক্তিকর, একঘেয়ে মনে হতে পারে। কিন্তু উদ্যম হারাবে না। আমি আবারো বলছিঃ উদ্যম হারাবে না। শুধু যেতে থাকো এবং সব ঠিক থাকলে তোমরা আমাকে দেখতে পাবে, শীঘ্রই!
নুয়ান কিছু একটা বলতে চেয়েছিলো, কিন্তু তার আগেই আবার আচমকা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এই ফ্যারিহাড ক্যারেক্টারটা আজব – মনে মনে ভাবতে থাকে নুয়ান।
নুয়ান এবং সিমিত পরবর্তী কয়েক ঘন্টা একঘেয়েভাবে রেন-স্রোত অনুসরণ করে চলতে থাকে। নিতান্ত ঘটনাবিহীন যাত্রা। তবে ওরা অবশ্যই রেন –এর আরো গভীরে নামছে – এটা নিশ্চিত। ওরা ইলেভা-৩ –এ যাচ্ছে! কোনো কথা হয় না, তবে ভিতরে ভিতরে উভয়েই কিছুটা অধীর হয়ে পড়ে। আর কত যাওয়ার বাকী?
অতঃপর আকস্মিকভাবে কিছু ঘটনা ঘটতে থাকে। ওদের রেন-পোর্টারটা হঠাত বেগ বাড়াতে থাকে, কিন্তু সিমিতের এতে কোনো হাত থাকে না। নিয়ন্ত্রণ এক প্রকার হাতছাড়া হয়ে গেছে! আর দমকি হাসির মত শব্দটা এখন বেশ জোরালো হয়ে উঠেছে। যেন একসঙ্গে লক্ষ লক্ষ হাসির মত শব্দ জুড়ে গিয়ে ভারী অনুনাদ(রেসোনেন্স) –এ প্রকম্পিত হচ্ছে চারপাশ। মাথা ঘুরাতে থাকে...রেন-পোর্টারটা এখন অকল্পনীয় বেগে ছুটে চলেছে! তারপর আচমকা থেমে গেলে একটা অত্যুজ্জ্বল আলোয় চোখ ধাধিয়ে গেলো।
ওদের মনে হলোঃ নিমিষে ক্ষুদ্র জীবনের সমস্ত স্মৃতি লুপ্ত হয়ে গেলো সেটা মেকা হোক কিংবা মানুষের! চেতন-অবচেতনের মাঝামাঝি এক ধরণের বাধা অতিক্রম করে ফেলে। তারপর ওরা পুরোপুরি অচেতন হয়ে পড়ে।
=========================================================================
শব্দ-কোষঃ
২৬. ইলেভাঃ কাল্পনিক, রেন –এর গভীরে থাকা স্তরসমূহ।
২৭. ন্যানমেকঃ কাল্পনিক, উচ্চ-যেলড্রিয়ান ন্যানো ট্রাকিং মেকা (যন্ত্র)
২৮. লেনপ্রবঃ কাল্পনিক, সারভেইল্যান্স রিপোর্টিং ডিভাইস। লেনপ্রবে রিপোর্টকারির নানান জরুরী অবস্থার বর্ণনা, পর্যবেক্ষণ, সিদ্ধান্ত, সুপারিশ ইত্যাদি সম্ভাব্যতার নিঁখুত বিচারে শ্রেণিবিন্যাস করে সেই ঘটনাগুলি চলচিত্রের মত করে দেখানোর ব্যবস্থা আছে।
চলবে....