ব্ল্যাকবেরি সেবার সংরক্ষিত তথ্যে আইনগত প্রবেশাধিকার (এলআই) না থাকায় এর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিঘ্নের আশঙ্কা করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করা ও অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকির বিষয়টিও বিবেচনা করা হচ্ছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে দেশে বন্ধ করা হতে পারে ব্ল্যাকবেরি সেবা। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে। তবে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাসহ সমাজের অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি এর গ্রাহক হওয়ায় সেবাটি সহসাই বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
এ প্রসঙ্গে বিটিআরসির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ব্ল্যাকবেরি সেবার সংরক্ষিত তথ্যে কোনো প্রবেশাধিকার পাওয়ার সুযোগ নেই। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর প্রয়োজনে এ ধরনের তথ্যে প্রবেশাধিকারের সুযোগ রাখার বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের জানানো হলেও তা নিশ্চিত হয়নি। এজন্য সেবাটি বন্ধ করে দেয়ার কথা ভাবছে বিটিআরসি। সম্প্রতি কমিশনের এক বৈঠকে এ বিষয়ে আলোচনা হয়। তবে ওই কর্মকর্তা জানান, ব্ল্যাকবেরি সেবা বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত হলেও এক্ষেত্রে অপারেটরদের তিন মাস সময় দেয়া হতে পারে।
ব্ল্যাকবেরি পোস্টপেইড সেবার ক্ষেত্রে ব্ল্যাকবেরি এন্টারপ্রাইজ সার্ভিস (বিইএস), ব্ল্যাকবেরি ইন্টারনেট সার্ভিস (বিআইএস) ও ব্ল্যাকবেরি মেসেঞ্জার সার্ভিস (বিএমএস) নামের তিনটি সেবা রয়েছে। এ সেবাগুলোর মাধ্যমে বিনিময় করা তথ্যগুলো খুবই সুরক্ষিত (এনক্রিপ্টেড) থাকে। এগুলো জমা হয় ব্ল্যাকবেরি নির্মাতা রিসার্চ ইন মোশনের (আরআইএম) সার্ভারে। প্রতিষ্ঠানটির উন্নত প্রযুক্তির এনক্রিপশন পদ্ধতির কারণে এ সার্ভার থেকে পাওয়া তথ্য পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয় না। কেবল গ্রাহকের হ্যান্ডসেট (এনক্রিপ্টর) ও প্রাপকের হ্যান্ডসেটের (ডিক্রিপ্টর) মাধ্যমেই সেগুলো প্রবেশ করা যায়।
ব্ল্যাকবেরি গ্রাহকদের মধ্যে আদান-প্রদান করা তথ্যে অন্য কারো প্রবেশাধিকার না থাকার কারণেই বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিষয়টি ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনা করা হচ্ছে। দেশে গ্রামীণফোন ও এয়ারটেলের গ্রাহকদের জন্য ব্ল্যাকবেরি সেবা চালু রয়েছে। গ্রামীণফোনের ব্ল্যাকবেরি সেবার গ্রাহকসংখ্যা ৪ হাজার ৬৬৪ আর এয়ারটেলের ১ হাজার ৬৬১। প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবহারকারীর মধ্যে রয়েছে— প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগসহ বেশকিছু সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। আর বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়াসহ কয়েকটি দূতাবাস এ সেবার গ্রাহক।
বিটিআরসি সূত্রে জানা গেছে, অনুমোদনের শর্তানুযায়ী সেবা চালুর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ব্ল্যাকবেরি সেবার সংরক্ষিত তথ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন সংস্থার প্রবেশাধিকারের বিষয়টি নিশ্চিত করার কথা থাকলেও প্রতিষ্ঠানগুলো এখন পর্যন্ত তা করতে ব্যর্থ হয়েছে। এজন্য গত বছরের ২০ মে গ্রামীণফোন ও এয়ারটেলকে কারণ দর্শানোর নোটিস দেয় বিটিআরসি। নোটিসের জবাবে গ্রামীণফোন ও এয়ারটেল জানায়, বিইএস সেবা আইনগত প্রবেশাধিকার বা এলআইয়ের আওতাবহির্ভূত এবং তাত্ক্ষণিকভাবে অন্য দুটি সেবার এলআইও নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
এলআই নিশ্চিত করতে বেশকিছু প্রস্তাবনা দিলেও প্রতিষ্ঠান দুটি নির্ধারিত সময়ের পরও তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। বিষয়টি নিয়ে ওই বছরের ২৯ মে আরআইএমের সঙ্গেও বৈঠক করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
বিশ্বব্যাপী ৯১টি দেশের প্রায় ৫০০ অপারেটর ব্ল্যাকবেরির এ সেবা দিয়ে থাকে। একক ব্যবহারকারী হিসেবে এর সবচেয়ে বড় গ্রাহক যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ। প্রতিষ্ঠানটির প্রায় আড়াই লাখের মতো ব্ল্যাকবেরি সেবার সংযোগ রয়েছে। বর্তমানে ব্ল্যাকবেরির মূল সেবা নিয়ন্ত্রণ করা হয় কানাডা থেকে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অঞ্চলভিত্তিক সার্ভার রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। সেবার মানোন্নয়নে ইংল্যান্ড, দুবাই, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে সার্ভার বসিয়েছে তারা। বাংলাদেশের ব্যবহারকারীরা ব্ল্যাকবেরির গ্লোবাল সার্ভারের মাধ্যমে বিভিন্ন সেবা পেয়ে থাকে।
শুধু বাংলাদেশেই নয়, ব্ল্যাকবেরির সেবাসংক্রান্ত এ জটিলতা তৈরি হয়েছে বিভিন্ন দেশে। ফ্রান্স, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইন্দোনেশিয়া, লেবানন, চীন, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশ এ সেবা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে দেশগুলোয় ব্ল্যাকবেরির সার্ভার স্থাপনের নির্দেশ দেয়া হয়।
প্রসঙ্গত, একসময় স্মার্টফোনের বাজার সম্পূর্ণভাবে আরআইএমের দখলে ছিল। ব্ল্যাকবেরির প্রথম স্মার্টফোন বাজারে আসে ১৯৯৯ সালে। মূলত বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রয়োজনে ব্ল্যাকবেরি ব্যবহার হতো। তবে সাধারণ ব্যবহারকারীদের কাছে সময়মতো পৌঁছতে ব্যর্থ হয়েছে এটি। ব্ল্যাকবেরির ওপর প্রথম ধাক্কাটি লাগে অ্যাপলের আইফোন বাজারে আসার পর। এরপর গুগলের অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমভিত্তিক (ওএস) স্মার্টফোন বাজারে আসায় হুমকির মুখে পড়ে ব্ল্যাকবেরি।
>> দৈনিক বণিক বার্তা