পূর্বেঃ দেখা হয়নি চক্ষু মেলিয়া......
সেদিন দুপুর বেলা বাইরেই খাওয়াদাওয়া করলাম। শাতিল খিলাড়ীদের মতন দুপুরের লাঞ্চ থেকে সরকারী কর্মকর্তা আঙ্কেলকে মাইনাস করে দিয়ে, খরচ বাঁচানো হলো। সবার মুখে যুদ্ধজয়ের হাসি। খাওয়াদাওয়া করে ভাবলাম একটু রেস্ট নিবো। কিন্তু কিসের কি? ইনসোম্যানিক সাইকো অর্নবের পেইন খেয়ে সবাই বেরিয়ে পড়লাম শহরের কাছেই অবস্থিত বৌদ্ধদের স্বর্ণমন্দির দেখতে। যাওয়ার পরে দেখি মন্দিরটা একটা ছোটখাটো পাহাড়ের উপরে। মেজাজটা আরও খারাপ হয়ে গেলো যখন এ যাত্রার নতুন হিরো বেবী, পাহাড়ে ওঠার সিড়ির কাছে থাকা ফেরীওয়ালাদের কাছ থেকে পেঁপে কিনতে চাইলো। এর আগে একবার আমার আর অর্নবের রাঙ্গামাটি গিয়ে বেবীর পাহাড়ি পোকা ধরা আম কেনা দেখার সৌভাগ্য হয়েছিলো। তাই আমি রক্তচক্ষু দেখালাম বেবীকে। আর অর্নব তার নতুন স্ট্রেটেজীর অংশ হিসেবে হাসতে হাসতে বললো, “নাহ, আমি কিন্তু বেবীর সাথে রাগ করিনা। তাই না বেবী? তুই অনেক মজা দিস আমাদের। এখন এই পেঁপে কিনিস না। কেমন বেবী? কথা শুনলে তোকে মিস্টার ম্যাঙ্গো খাওয়াবো। ” যাক বেবী এবার আমাদের কথা শুনলো। তবে পরবর্তীতে জেনেছিলাম যে, পাহাড়ি আম অখাদ্য হতে পারে, কিন্তু পাহাড়ি পেঁপে নাকি অতি সুস্বাদু!
সিড়ি উঠতে উঠতে যখন প্রাণ প্রায় ওষ্ঠাগত, তখন কিছু ঘর দেখলাম। টিনের ঘর। ওখানে মনেহয় ছোট ছেলেমেয়েরা পড়াশুনা করে। আর তারপরই হচ্ছে স্বর্ণমন্দিরের সিঁড়ি। সিঁড়ির নিচে জুতা খুলে প্রবেশ করতে হয়। এজন্যে সামান্য টাকা নিয়েছিলো মনেহয়। মনে নাই। উপরে মন্দিরের মূল কক্ষ। ভিতরে বুদ্ধের অনেকগুলো চমৎকার ভাস্কর্য। চারিদিকে অনেকগুলো মিনার। সবগুলো সোনালী রঙের। এজন্যেই মনেহয় এরকম নামকরণ। সবকিছু খুব পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন। উপরে উঠলে প্রশান্তিতে ভরে যায় মন। মন্দির থেকে নিচে তাকালে বান্দরবান শহরের একাংশের সৌন্দর্য্য দেখা যায়। একটা প্লেটের মতন ঘন্টা আছে বাইরে। সেটা হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি মেরে বাজানো যায়। দুইজন সাধুকে পেলাম সেখানে। লোভ সামলাতে না তাদেরকে অনেকদিনের জমে থাকা একটা প্রশ্ন করেই ফেললাম। “আচ্ছা, আপনারা কি এখন আর মার্শাল আর্ট টার্ট পারেন না? আসলে সব মুভিতে দেখিতো, তাই জিজ্ঞেস করছি। ” ভেবেছিলাম সাধু আমার কথা শুনে রেগে যাবেন। কিন্তু না। উনি হাসতে হাসতে বললেন, “আগেকালের সাধুরা বনেজঙ্গলে ধ্যান করতো। বন্যপশুর আক্রমণের ভয় ছিলো। আশ্রমগুলো ছিলো দূর্গম সব জায়গায়। এজন্যে তারা আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে মার্শাল আর্ট শিখতেন। আক্রমণ করতে নয়। এখনতো আর তেমন বনজঙ্গলও নেই। মন্দিরগুলোও আর দূর্গম জায়গায় নেই। তাই আমাদের সেভাবে মার্শাল আর্ট শেখারও দরকার হয় না।”
বৌদ্ধমন্দির থেকে ঘুরে আসার পরে আমাদের অবাক হবার পালা। সেই কর্মকর্তা আঙ্কেল কল দিয়েছেন। রাতের খানা তার সরকারী বাসভবনে। আমরা সবাই একসাথে বেবীর দিকে তাকালাম। বেবী বললো, “আশ্চর্য্য, এমন করে তাকানোর কি আছে? সকালের নাস্তা আর দুপুরের খানাটাও ওনার খাওয়ানো উচিত ছিলো। ” যাই হোক, আমরা ওনার বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। হোটেল থেকে খুব বেশি দূরে নয়। বাসায় যাবার সময় বেবীর মোবাইলে, সাত সমুদ্র তেরো নদী ওপার থেকে তার নতুন প্রেয়সী আমেরিকান তিমির কল এলো। আমাদের মধ্যে হিরো হতে না পারার দুঃখে জর্জরিত জনিকে ,সবাই ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজের মাস্টার হিসেবে জানে। ল্যাব এবং ক্লাস চলাকালীন সময়ে জি.আর.ই অধ্যয়ন এবং অন্যদেরকে কঠিন কঠিন ইংরেজী শব্দবাণে ঘায়েল করার কারণে তার নামও হয়ে গিয়েছিলো জিআরই-জনি। আমরা ভাবলাম এই ফাকে শেষ রাইতে ওস্তাদের মাইরের টেস্ট হয়ে যাক। ফর্মে থাকা নতুন হিরো বেবীর সম্মতিতে তার প্রেয়সী, সেই খাঁটি আমেরিকান তিমির সাথে কথা বলার জন্যে জনিকে ফোন ধরিয়ে দেয়া হলো। আমরা হতবাক হয়ে দেখলাম যে, ফোন ধরার সাথে সাথে জিআরই-জনি মুহূর্তের মধ্যে টারজান-জনি হয়ে গেলো, আর বলতে থাকলো, “আই জনি.........ইউ বেবী গার্লফ্রেন্ড.........উই ফ্রেন্ড......”।
রাতে সেই আঙ্কেলের বাসায় ব্যাপক খানাদানা করলাম। মুরগী ভুনা, খিচুরী, গলদা চিংড়ী, গরু, ডিমের কোরমা। মারহাবা মারহাবা। আঙ্কেল ও তার বাবুর্চিকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলাম। হোটেলে ফেরার সময় মনে হলো, এই শীতের রাতে চা খেতে পারলে মন্দ হতো না। তখন রাত দশটা। বান্দরবান শহরে গভীর রাত। দেখলাম একটা মাত্র ছাপড়া-হোটেল বন্ধ হবে হবে অবস্থায়। আমরা গিয়ে হাজির হলাম। বিক্রীবাট্টা মনেহয় ভালো হয়নি সারাদিন। শেষ মুহূর্তে কাস্টমার আসায় মনে হলো মালিক বেশ খুশিই। তখনও অবশ্য মালিক বোঝে নাই যে তার দোকানে শনির রূপে বেবী এসেছে। যাই হোক। চায়ের অর্ডার দেয়া হলো। লাল চা। আমরা সবাই যখন সবে চায়ে চুমুক দেয়া শুরু করেছি, তখন বেবী চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ভ্রু কুচকে বললো,
- অ্যাহহে মামা। এইডা কি চা দিলা? যাও, আরেকটু লিকার দিয়া আনো।
আগত্য দোকানের মামা ভিতরে চলে গেলো , আর একটু পরে আবার চা নিয়ে এলো। বেবী চা মুখে দিলো, আর ঠোটমুখ কুচকে বলে উঠলো,
- ইয়্যাক!! চায়ে চিনি দাও নাই নাকি? যাও, আরও চিনি দিয়া আনো।
আমি আর অর্নব, ওর সাথে ট্যুর দেয়ার পূর্ব অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করছি। অন্যরা কিছুটা বিরক্ত এবং কিছুটা হতবাক! যাই হোক, আবারও চা এলো। এবারে চা মুখে দিয়ে বেবী বলে উঠলো,
- শুধু লিকার দিয়া লাল চা দিলা? আর কিছু নাই? লেবু বা আদা?
- নাই মামা।
- এই সাধারণ জিনিস নাই। আছেটা কি তোমার দোকানে?
- তেজপাতা আছে।
- হম্ম......... কি আর করার তাইলে...... আইচ্ছা যাও, তেজপাতা দিয়া নিয়া আসো।
শুভ্র, নাহিদ আর জনি এসব দেখে বেশ বিরক্ত হয়ে বেবীকে কিছু বলতে গেলো। কিন্তু আজকে দুপুরে দেশের টপ অভিনেত্রীর সাথে কোলাকুলি করা বেবীর নায়কোচিত মূর্তি দেখে আর সেই সাহস করলো না। অবশেষে, দোকানের ক্লান্ত মামা আবারও তেজপাতা দিয়ে বেবীর জন্যে চা নিয়ে এলো। বেবী চা মুখে দিলো। দোকানে পিনপতন নীরবতা। আমরা কয়েকজন ফিঙ্গার-ক্রস করে বসে আছি। অতঃপর চা মুখে দিয়ে বেবী নীরবতা ভাংলো।
- অ্যাহহে! চা তো জুড়ায় গেলো............ যাও, একটু গরম করে নিয়া আসো।
সবাই রাগে বুম হয়ে বসে থাকলো। শুধু অর্নব হো হো করে হাসতেই থাকলো। হাসতে হাসতেই বললো, “হা হা হা হা......... আমি কিন্তু বেবীর উপর একদম রাগ করবো না........একদমই না....... হু হু হু হু......... ওরে, তোরা কেউ একটা বোতল নে.........হি হি হি হি.........তারপর সেইটা দিয়ে আমার মাথায় বাড়ি মার.........”
[চলবে]