Quantcast
Channel: প্রজন্ম ফোরাম
Viewing all articles
Browse latest Browse all 15150

এক ছিলিম মোনালিসা

$
0
0

ফুমাতো পোট্রেটের একটি স্বাভাবিক কাজের মধ্যে এমন কি রহস্য লুকিয়ে থাকতে পারে যা যুগ যুগ ধরে অসংখ্য মানুষকে ব্যাকুল করে রেখেছে? প্রশ্নটা রেঁনেসার একজন গ্রেট আর্টিস্টের অসাধারণ এক মাস্টারপিসকে নিয়ে। মোনালিসা নামেই বিশ্বব্যাপী যার পরিচিতি।

একেবারে শুরু থেকেই মোনালিসা ছিল বিশেষ কিছু। ভিঞ্চির সমসাময়িক অনেক শিল্পীই মোনালিসাকে অসাধারণ বলেছেন। এদের মধ্যে রাফায়েলও আছেন। সকলেই যেন এর ভবিষ্যত আন্তাজ করতে পারছিলেন। অথচ স্বাভাবিক নিয়মে এরকমটি হওয়া উচিত ছিলনা। সাধারণত পোট্রেট আকাঁর জন্য একজন চিত্রকরকে ভাড়া করা হয়। তিনি রক্ত মাংসের মডেলকে রং তুলিতে ক্যানভাসে বন্দী করেন। যে বা যারা আকঁতে দিত তারাই এর মালিক হতো। কিন্তু মোনালিসার বেলায় দেখা গেল অন্য কিছু। শিল্পী এটি নিজের কাছেই রেখে দেন এবং সৃষ্ঠি করেন মোনালিসার আদি রহস্য।

সবচেয়ে বহুল প্রচলিত ধারণা অনুসারে মোনালিসা হলো লিসা গেরার্দিনির প্রতিকৃতি। ভিঞ্চির সমকালীন চিত্রকর ও ইতিহাসবিদ গিওর্গিও ভাসারির দেয়া সূত্রমতে লিসা হলেন আন্তোন মারিয়া দি লোন্দো গেরার্দিনির মেয়ে এবং ফ্রান্সেস্কো দি বার্তোলোমিও দি জানোবি দেল গিওকোন্দার স্ত্রী। ইতালিতে মোনালিসার পরিচয় তার পদবী অনুসারে, ‘লা গিওকোন্দা’ (ফ্রান্সে ‘লা জোকান্দে’)। ভাসারির দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৫০০ থেকে ১৫০৬ সালের মধ্যে মোনালিসাকে আকাঁ হয়। কেনেথ ক্লার্ক ১৯৮৯ সালে পেঙ্গুইন থেকে প্রকাশিত তাঁর Leonard da Vinci নামক বইয়ে আমাদের জানান, “ভিঞ্চি লিসা গেরার্দিনির নকশাটা আকেঁন ১৫০৪ সালে এবং প্রতিকৃতি তৈরীর কাজ শেষ করেন ১৫০৬ থেকে ১৫১০ এর মধ্যে।” প্রাপ্ত প্রায় সকল তথ্য হতেই এটা নিশ্চিত হওয়া যায় যে, মোনালিসার সম্পূর্ণ হতে সময় লেগেছিল কমপক্ষে চার বছর। এ দীর্ঘ সময়, নিশ্চিতভাবেই ধরে নেয়া যায়, মোনালিসাকে অনেক বিবর্তিত করেছে। এমন হওয়াও অসম্ভব নয় যে,  শেষ পর্যন্ত  মোনালিসা আর লিসা গেরার্দিনি থাকেনি কেননা সময়ক্ষেপনের ফলে ভিঞ্চির পক্ষে মূল ড্রয়িং অনুসরণ করা হয়ে উঠেনি এবং মোনালিসা কারও প্রতিকৃতি থাকেনি। হয়তো এই কারণেই ভিঞ্চি এর মালিকানা হস্তান্তর করেন নি।

তার অর্থ এই দাড়াঁয় যে, মোনালিসার জীবন শুরু হয় লিসা গেরার্দিনির প্রতিকৃতি হিসাবে এবং শেষপর্যন্ত পরিণত হন অন্য একজনে। এই রূপান্তর ধারণা আরেকটি নতুন আইডিয়ার জন্ম দেয়। ১৯৭৮ সালে জেরোমে দ্য বাসানো একটি ম্যাগাজিনে ব্যাখ্যা দেন, “চুক্তি মতো ভিঞ্চি লিসার তৈলচিত্র আকেঁন এবং আইন অনুযায়ী তাঁর স্বামীকে দিয়ে দেন। হস্তান্তরের আগে ভিঞ্চি উক্ত চিত্রকর্মটির আরেকটি কপি করেন এবং সেটাকে মোনালিসায় পরিণত করেন।” বাস্তব কোন প্রমাণ নেই তারপরও এই থিউরিতে ম্যাজিক আছে।

আরেকটি অসম্ভব জনপ্রিয় থিউরি হলো, মোনালিসা আসলে অন্যকেউ নন, স্বয়ং দা ভিঞ্চি। ১৯৫২ সালে ছবিটি এক্সরে করালে এ ধারণা ভাল একটা ভিত পায়। ১৯৮৬ সালে বেল ল্যাবরেটরির কম্পিউপটার আর্ট সাইন্টিস্ট লিলিয়ান শোয়ার্জ এই ধারণাকে পোক্ত করতে বেশ কিছু তথ্য প্রমাণ নিয়ে হাজির হন। ১৯৫৬ সালে জর্জ ইসারলো নামের একজন চিত্র সমালোচক জানান, মোনালিসা আসলে উভলিঙ্গ!

মোনালিসা লিসাই হোন, কিংবা ভিঞ্চি নিজে অথবা অন্য কোন মডেল তাতে তার আবেদনে বিন্দু মাত্র কমতি  পরবেনা। কিন্তু তার আবেদনটা কি? কেন এটি দুনিয়ার সবচেয়ে বিখ্যাত শিল্পকর্ম? তবে কি এর কোন অন্তর্নিহিত গুণ আছে যার টানে সকলকে এর কাছে ফিরে আসতে হয়? শিল্পের ইতিহাসবিদ কেনেথ ক্লার্ক-এর মতে, “মোনালিসার রয়েছে ঐন্দ্রজালিক শক্তি।” ডোনাল্ড সাসুন তাঁর বিখ্যাত ‘মোনালিসা’ বইতে বলেন, “মোনালিসা কর্তৃত্বপূর্ণ কারণ সে কর্তৃত্ব করে দর্শকের উপর। আমরা যতো না তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকাই তার চেয়ে অনেক বেশি স্থির দৃষ্টিতে সে আমাদের দিকে তাকায়। সে যতোটা না আমাদের মনোযোগের বিষয় তার চেয়ে আমরা অনেক বেশি তার মনোযোগের বিষয়।”

আর তার হেয়ালিঁমাখা হাসি?
চিত্রকলা সম্পর্কে ধারণাহীন যে কোন মোনালিসাভক্ত তার হাসিটার কথায় সবার আগে স্মরণ করবেন। হয়তো এক কথায় রায় দিয়ে দিবেন - মোনালিসা বিখ্যাত তার রহস্যময় হাসির জন্য। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে সত্য এই যে, মোনালিসার হাসিতে রহস্য আরোপিত হয়েছে মাত্র উনিশ শতকে। এর আগে কেউ এ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলেছেন বলেও জানা যায়নি। তাছাড়া রেনেসাঁ যুগের শিল্পকর্মে এমন হাসি কোন বিরল ঘটনা নয়। ভিঞ্চিরও আগে অনেকে এর প্রয়োগ দেখিয়েছেন। ১৪৭০ সালে আনতোনেল্লো দা মেসিনো’র আকাঁ ‘পোট্রেইট অব আননোন ম্যান’ এর একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে। এখানেও পোট্রেটের মানুষটি মোনালিসার মতো আমাদের দিকে চেয়ে দুষ্টুমিমাখা হাসি হাসছে। কিন্তু তার হাসি কারো মন গলাতে পারেনি। একই পরিণতি ঘটেছে ভিঞ্চিরই আঁকা বাক্কাস, সেন্ট জন দ্য ব্যাপ্টিস্ট কিংবা সেন্ট এ্যান উইথ ভার্জিন এন্ড চাইল্ড এর ভাগ্যেও।

তবে এ কথা সত্যি যে মোনালিসা রাতারাতি তারকায় পরিণতি হননি। এর প্রধান কারণ মোনালিসা নিজেই। মোনালিসায় ভিঞ্চি এত তুলির এত সূক্ষ ও জটিল প্রয়োগ ঘটিয়েছেন যে এর কপি করা ছিল একটি ভয়াবহরকম দূরোহ কাজ। এর খোদাইকাজে প্রথম সাফল্য অর্জন করেন ইতালির একজন খোদাইকার লুইগি কালামাত্তা ১৮৫৭ সালে। তিনি কাজ শুরু করেন ১৮৩৮ সালে এবং এই একটি ছবির খোদাইর কাজ শেষ করতে লাগিয়ে দেন প্রায় বিশটি বছর। মূলত উনিশ শতক পর্যন্ত ভিঞ্চির কাধেঁ চড়েই চলে মোনালিসার বিশ্বভ্রমণ। কিন্তু পরবর্তী শতক মোনালিসার জন্য ছিল অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এই শতকেই ভিঞ্চির কাধঁ থেকে নেমে নিজ পায়ে হাটাঁ শুরু করে মোনালিসা। একটি প্রতিকৃতি থেকে পরিণত হয় একটি কাল্টে। মোনালিসা কাল্ট।

মোনালিসা, যা একটি তৈলচিত্রের চেয়েও বেশী কিছু, যার মধ্যে এমন কিছু আছে যা আমাদের সবার সাথেই কথা বলে, প্রকাশ করে অনুভূতি। তার দৃষ্টি আমাদের আবেগাক্রান্ত করে। তার প্রহেলিকাময় হাসি আমাদের মনের গোপন কোন সত্য জেনে ফেলার কথায় হয়তো বলে।

অবিনশ্বরতা পাওয়া সহজ বিষয় নয়। এবং একবার এটি অর্জনের পর ধ্বংস করাও প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। মোনালিসার ভাগ্যে তাই ঘটেছে। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি নামক অবিনশ্বর একজন শিল্পীর অবিনশ্বর একটি চিত্রকর্ম হিসাবে এটি বেচেঁ থাকবে শেষদিন পর্যন্ত।
--------------------
তথ্যসূত্র: Mona Lisa/Donald Sassoon


Viewing all articles
Browse latest Browse all 15150

Trending Articles



<script src="https://jsc.adskeeper.com/r/s/rssing.com.1596347.js" async> </script>