উইলিয়াম আলবার্ট “বিল” ডেম্বস্কি (William Dembski) অনিয়ন্ত্রিত ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রাণের বিকাশ এবং সেখান থেকে বিবর্তনের তত্ত্বের একজন অন্যতম সমালোচক। তিনি ১৯৬০ সালে শিকাগোর ইলিনয়ে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর মা একজন আর্ট ডিলার (art dealer) ছিলেন এবং তাঁর বাবা ছিলেন কলেজের প্রফেসর এবং লেকচারার। ডেম্বস্কির পিতা ইউনিভার্সিটি অফ এরল্যাংগেন-নুরেমবারগ (University of Erlangen-Nuremberg) থেকে জীববিজ্ঞানের উপরে ডক্টর অফ সাইন্স বা ডি.এসসি (D.Sc) লাভ করেন। তিনি বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞান (evolutionary biology) শিক্ষা দিতেন। সুতরাং ছোটবেলা থেকেই ডেম্বস্কি ইভল্যুশন ফ্রেন্ডলি একটি পরিবেশে বড় হয়েছেন। ডেম্বস্কি ১৯৮১ সালে শিকাগোর ইউনিভার্সিটি অফ ইলিনয় (University of Illinois) থেকে মনোবিজ্ঞানের উপর আন্ডার গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি লাভ করেন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ১৯৮৩ সালে পরিসংখ্যানের উপর মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। এরপরে ১৯৮৫ সালে তিনি ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগো (University of Chicago) থেকে গণিতের উপর মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৯৩ সালে তিনি শিকাগোর ইউনিভার্সিটি অফ ইলিনয় থেকে দর্শন শাস্ত্রের উপরও একটি মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। এছাড়াও তিনি ১৯৯৬ সালে প্রিন্সটন থিওলজিক্যাল সেমিনারি (Princeton Theological Seminary) থেকে থিওলজি (theology) বা ধর্ম তত্ত্বের উপর মাস্টার অফ ডিভিনিটি (Master of Divinity) লাভ করেন। শিক্ষাজীবন শেষে তিনি ১৯৯৯ সালে বেইলর ইউনিভার্সিটির (Baylor University) তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রবার্ট বি. স্লোন (Robert B. Sloan) কর্তৃক আমন্ত্রিত হন। বেইলর ইউনিভার্সিটিতে রবার্ট স্লোন “মাইকেল পোলানি সেন্টার” (Michael Polanyi Center) প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই ডেম্বস্কিকে আমন্ত্রন জানান। ১৯৯৯ সালে ডেম্বস্কি একজন পোস্ট ডক্টরাল রিসার্চ ফেলো হিসেবে ডিসকভারি ইন্সটিটিউটের (Discovery Institute) সাইন্স এন্ড কালচার (Center for Science and Culture) বিভাগে যোগদান করেন। ২০০৮ সাল থেকে তিনি সেখানকার একজন সিনিয়র ফেলো হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। এছাড়াও ডেম্বস্কি বর্তমানে উত্তর ক্যারোলিনার ম্যাথিউসে অবস্থিত সাউদারন ইভেঞ্জেলিকাল সেমিনারির (Southern Evangelical Seminary) কালচার এন্ড সাইন্স এর ফিলিপ ই. জনসন রিসার্চ প্রফেসর হিসেবে কর্মরত অবস্থায় আছেন। ১৯৯৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ডেম্বস্কি প্রবাবিলিটি, চান্স, কমপ্লেক্সিটি, ডিজাইন ইত্যাদি বিষয়ের উপরে ৫টি বই লিখেছেন এবং তিনি আরও ৭টি বইয়ের সহ লেখক। এছাড়াও তিনি আরও ৬টি বইয়ের সম্পাদক বা সহায়ক ছিলেন।
[ডেম্বস্কির এই সংক্ষিপ্ত বায়োগ্রাফি এখানে দেবার উদ্দেশ্য হল এই যে, কারও মনে যেন তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা, বুদ্ধিমত্তা ও পারিবারিক ব্যাকগ্রাউনড নিয়ে কোন প্রকার সন্দেহ না থাকে।]
ডেম্বস্কি বলেন যে জীবজগতের এই অসাধারন জীব বৈচিত্র্যতার উৎপত্তি ও বিকাশ পরিসংখ্যানগতভাবে শুধুমাত্র প্রাকৃতিক নির্বাচন বা ন্যাচারাল সিলেকশন (natural selection) দ্বারা সম্ভব হতে পারে না। তিনি অনিয়ন্ত্রিত বিবর্তন ও স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণের উদ্ভবের বিপক্ষে গণিত ও ইনফরমেশন থিওরির (information theory) উপর ভিত্তি করে স্পেসিফাইড কমপ্লেক্সিটি বা সুনির্দিষ্ট জটিলতা (Specified complexity) নামে একটি তত্ত্ব প্রস্তাব করেন। এই তত্ত্বটি এলোমেলো একটি সিস্টেম থেকে অনিয়ন্ত্রিতভাবে প্রাণের উদ্ভব ও বিবর্তনের গানিতিকভাবে বিরোধিতা করে। তাঁর মতে এই তত্ত্বটি একজন প্রচণ্ড বুদ্ধিমান ডিজাইনার বা স্রষ্টার অস্তিত্বের দিকে নির্দেশ করে। এই তত্ত্বটি ডিসকভারি ইন্সটিটিউট এবং বুদ্ধিমান ডিজাইনের (intelligent design) সমর্থকদের একটি অন্যতম প্রমান। এই তত্ত্বের সরাসরি কোন ব্যাবহার গনিত বা ইনফরমেশন থিওরিতে করা এখনও পর্যন্ত সম্ভব হয়নি, তাই বিজ্ঞান মহলের এই তত্ত্বকে প্রত্যাখ্যান করার এটি একটি কারন। অবশ্য সেদিক থেকে চিন্তা করতে গেলে বিবর্তনবাদেরও কোন ব্যাবহারিকতা বা উপকারিতা নেই! বরং ক্ষেত্র বিশেষে আছে অপকারিতাই!! তবে সেটি পরের বিষয়। ডেম্বস্কির দেওয়া তত্ত্বটিকে ইন্টালিজেনট ডিজাইনের সমর্থক একাডেমীক ও বিজ্ঞানীরা একযোগে মেনে নিলেও তাঁর তত্ত্বটি মিডিয়াতে তেমনভাবে প্রচার পায়নি। এছাড়াও ডেম্বস্কির সকল লেখাতেই বিজ্ঞান ও দর্শনকে একত্রে উপস্থাপন করার কারনেও অনেকের কাছে তাঁর লেখা গ্রহণযোগ্য হয়নি যেহেতু অনেক বিজ্ঞানীর কাছেই দর্শন তত্ত্ব খুব একটা গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয় না। ফলস্বরূপ তাঁর তত্ত্বকেও তারা গ্রহণযোগ্য বলে মনে করে না।
স্পেসিফাইড কমপ্লেক্সিটি টার্মটি সর্বপ্রথম লেসলি অরগেল (Leslie Orgel) নামক প্রাণের উদ্ভবের (origin of life) একজন গবেষক ব্যাবহার করেন জীবকে জড় বস্তু হতে পৃথক করার জন্য। তাঁর দেওয়া সংজ্ঞানুসারে স্পেসিফাইড কমপ্লেক্সিটিঃ
In brief, living organisms are distinguished by their specified complexity. Crystals are usually taken as the prototypes of simple well-specified structures, because they consist of a very large number of identical molecules packed together in a uniform way. Lumps of granite or random mixtures of polymers are examples of structures that are complex but not specified. The crystals fail to qualify as living because they lack complexity; the mixtures of polymers fail to qualify because they lack specificity.
অনুবাদঃ সংক্ষেপে, জীবদেরকে তাদের সুনির্দিষ্ট জটিলতা দ্বারা পার্থক্য করা যায়। ক্রিস্টালকে সাধারনত সরল ও সুনির্দিষ্ট গঠনের নমুনা হিসেবে নেওয়া হয়, কারন ক্রিস্টালে অনেকগুলো একইরকম অণু একত্রে একই অবস্থায় থাকে। গ্রানাইটের স্তূপ বা পলিমারের এলোমেলো মিশ্রণ হল জটিল কিন্তু তারা সুনির্দিষ্ট নয়। ক্রিস্টাল জীবন্ত হবার যোগ্য নয় কারন তার মধ্যে জটিলতা কম; আর পলিমারের মিশ্রণ জীবন্ত হবার যোগ্য নয় কারন তার মধ্যে সুনির্দিষ্টতা কম।
পরবর্তীতে এই টার্মটি পল ডেভিস (Paul Davies) নামের একজন পদার্থবিদ দ্বারা ব্যাবহৃত হয়ঃ
Living organisms are mysterious not for their complexity per se, but for their tightly specified complexity
অনুবাদঃ জীবরা তাদের জটিলতার কারনে রহস্যময় নয়, বরং তাদের দৃঢ় সুনির্দিষ্ট জটিলতার কারনে রহস্যময়।
ডেম্বস্কি টার্মটিকে বর্ণনা করেন এভাবেঃ
স্পেসিফাইড কমপ্লেক্সিটি সে সকল কনফিগারেশনে অবস্থান করে যেসকল কনফিগারেশনকে এমন কোন ধরনের প্যাটার্ন দ্বারা বর্ণনা করা যায় যা কিনা বিশাল আকারের সুনির্দিষ্ট তথ্যকে স্বাধীনভাবে প্রদর্শন করে।
ডেম্বস্কি বিষয়টি আরও পরিষ্কার করার জন্য একটি সহজ ও সাধারণ উদাহরণ দেনঃ
A single letter of the alphabet is specified without being complex. A long sentence of random letters is complex without being specified. A Shakespearean sonnet is both complex and specified.
অনুবাদঃ বর্ণমালার কোনো অক্ষরই জটিল নয় কিন্তু সুনির্দিষ্ট। আবার এলোমেলো কতগুলো অক্ষর দ্বারা সৃষ্ট একটি দীর্ঘ বাক্য সুনির্দিষ্ট নয় কিন্তু জটিল। তবে শেক্সপিয়ারের একটি সনেট একই সাথে জটিল এবং সুনির্দিষ্ট।
বাস্তব ক্ষেত্রে এমন আরও অনেক ধরনের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। যেমনঃ “I HAVE A PEN” এই বাক্যের প্রতিটি অক্ষরই সুনির্দিষ্ট অর্থাৎ এদের প্রত্যেকের কাজ একদম সুনির্দিষ্ট কিন্তু এই অক্ষরগুলোর কোনটিই জটিল নয়। আবার এই অক্ষরগুলোকে একত্রে ইচ্ছামতো সাজানো হলে সেটি জটিল হবে কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোন অর্থ বহন করবে না। তবে যখন এই অক্ষরগুলো দিয়ে “I HAVE A PEN” বাক্যটি রচনা করা হয় তখন কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন অক্ষর নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে ব্যাবহার করার কারনে সেটি জটিল তো হবেই সেই সাথে আবার এই বাক্যটি শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতি বা প্যাটার্ন বা সিকোয়েন্স অনুসরন করে সাজিয়ে নির্দিষ্ট একটি অর্থ প্রকাশ করা যায় বলে এটি সুনির্দিষ্টও। কোন বানরকে যদি একটি টাইপ রাইটার বা কোন ধরনের টাইপিং মেশিন ধরিয়ে দেওয়া হয় এবং বানরটি যদি সেই টাইপ রাইটারে ইচ্ছামতো বাটন চাপতে থাকে (অর্থাৎ টাইপিং যদি অপরিকল্পিত ও এলোমেলোভাবে হয়ে থাকে) তাহলে “I HAVE A PEN” এই বাক্যটি তৈরি হয়ে যাওয়া সম্ভব না। এর কারন হল ইংরেজি বর্ণমালাতে ২৬টি বর্ণ রয়েছে। এর সবগুলো বাটনই ওই টাইপ রাইটারে থাকবে। এছাড়াও এক থেকে শূন্য পর্যন্ত আরও মোট ১০টি বাটন সংখ্যার জন্য বরাদ্দ থাকে। অর্থাৎ মোট বাটন সংখ্যা হয় ৩৬টি। এই ৩৬টি বাটন ছাড়াও টাইপ রাইটারে আরও অনেক বাটন থাকে, যেমন – স্পেস বার, ক্যাপস লক ইত্যাদি। টাইপিং মেশিনের সকল বাটন হিসাব করলে দেখা যায় যে “I HAVE A PEN” বাক্যটি গঠন করতে যে কয়টি অক্ষর প্রয়োজন হয়েছে বানরটির আঙ্গুলের চাপ সেসকল বাটনে পড়ার সম্ভাবনা তুলনামুলকভাবে কম, তবে অসম্ভব না। কিন্তু বাটনে চাপ পড়লেই শুধু হবে না। বানরের এলোমেলো চাপগুলো প্রয়োজনীয় অক্ষরগুলোর উপরে পরপর পড়তে হবে এবং প্রয়োজনীয় পরিমানে স্পেসও প্রয়োজনীয় স্থানে থাকতে হবে। অর্থাৎ ইংরেজি – A, E, H, I, N, P, V এই কয়েকটি সুনির্দিষ্ট অক্ষরের সুনির্দিষ্ট একটি এলাইনমেনট বা বিন্যাস ও সুনির্দিষ্ট স্থানসমূহে সুনির্দিষ্ট পরিমান স্পেসের কম্বিনেশনের ফলেই “I HAVE A PEN” এই বাক্যটির সৃষ্টি হবে। তবে দেখা যাচ্ছে যে বাক্যটির ভিতরে আবার A এবং E এই অক্ষর দুটি ২ বার করে আছে এবং স্পেস আছে তিনবার অর্থাৎ এখানে রিপিটেসন বা পুনরাবৃত্তি হয়েছে। সুতরাং সুনির্দিষ্ট এলাইনমেনট এবং কম্বিনেশনের সাথে আবার সুনির্দিষ্ট পরিমান রিপিটেসনও যুক্ত হয়েছে।
এখন আমরা একটি টাইপিং মেশিনের কথা চিন্তা করি যেখানে ইংরেজি বর্ণমালার ২৬টি অক্ষরের জন্য ২৬টি, ১ থেকে শূন্য পর্যন্ত ১০টি সংখ্যার জন্য ১০টি, স্পেসের জন্য ১টি বাটন এবং একটি এন্টার বাটন বিদ্যমান। তাহলে আমরা ৩৮টি বাটন বিশিষ্ট একটি টাইপিং মেশিন পেলাম (যদিও একটি টাইপিং মেশিনে সাধারনত আরও কিছু বাটন থাকে)। এবার আমরা দেখবো যে এধরনের একটি টাইপিং মেশিনের বাটন প্রেস করার মাধ্যমে ঠিক কতো প্রকারের কম্বিনেশন প্রস্তুত করা যেতে পারেঃ
৩৮টি বাটন দ্বারা সর্বমোট কম্বিনেসন তৈরি করা যেতে পারে, n^r = ৩৮^৩৮ = ১০^৭০টি [10 to the power 70] (প্রায়)
এখানে n = ৩৮ হল মোট বাটন বা চয়েস সংখ্যা এবং r = ৩৮ হল প্রতিবারে টাইপিং মেশিনে যত সংখ্যক বার বাটন প্রেস করা হয় তার সংখ্যা।
অর্থাৎ ১ এর পরে আরও ৭০টি শূন্য বসালে যে সংখ্যা পাওয়া যায় তাই হল মোটামোটি ভাবে ৩৮টি বাটন দ্বারা সৃষ্ট কম্বিনেশন সংখ্যা। এখন এই ১০^৭০ সংখ্যাটির ভিতরে রিপিটেসন বা পুনরাবৃত্তি সহ এবং রিপিটেসন ছাড়া সব ধরনের কম্বিনেশনই রয়েছে। অর্থাৎ আমাদের ওই কল্পিত টাইপিং মেশিনের ৩৮টি বাটন এলোমেলোভাবে ৩৮ বার বা তার থেকে কম সংখ্যক বার চেপে গেলে যে কম্বিনেশন আসবে তা ১০^৭০টি কম্বিনেশনের মধ্যেই থাকবে।
এই হিসাবটি হল সঠিক হিসাবের প্রায় কাছাকাছি একটি হিসাব। যারা এই হিসাবটি বুঝতে পারেনি তাদের বোঝার সুবিধার্থে আমি ২টি উদাহরন দিচ্ছিঃ
১ম উদাহরণঃ ধরি, ২টি অক্ষর ‘ক’ ও ‘খ’ দ্বারা রিপিটেসন বা পুনরাবৃত্তিসহ ২টি অক্ষর বিশিষ্ট কতটি কম্বিনেসন তৈরি করা সম্ভব তা আমাদের জানতে হবে।
সেক্ষেত্রে আমরা অক্ষর দুটিকে সাজিয়ে দেখি,
কখ, খক, কক, খখ
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে যে আমরা দুটি অক্ষর বা চয়েস থেকে রিপিটেসনসহ দুই অক্ষর বিশিষ্ট চার ধরনের কম্বিনেসন তৈরি করতে পারি। দেখা যাক যদি আমরা রিপিটেসন সহ কম্বিনেসন বের করার সূত্রটি প্রয়োগ করি তাহলে কি পাওয়া যায়,
n^r = ২^২ = ২ X ২ = ৪টি
অর্থাৎ কম্বিনেসন সংখ্যা হচ্ছে চার যা আমাদের উপরে সাজানো কম্বিনেসন সংখ্যার সাথে মিলে গেলো। এখানে মোট অক্ষর বা চয়েস সংখ্যা হচ্ছে n = ২ এবং যত সংখ্যক অক্ষর ব্যাবহার করে কম্বিনেসন তৈরি করবো তা হচ্ছে r = ২।
২য় উদাহরণঃ ধরি, তিনটি অক্ষর ক, খ এবং গ দেওয়া আছে। এই অক্ষর তিনটি দিয়ে রিপিটেসন সহ ২ অক্ষর বিশিষ্ট কতগুলো কম্বিনেসন তৈরি করা সম্ভব তা আমাদের জানতে হবে। সেক্ষেত্রে আমরা অক্ষর তিনটিকে ২টি অক্ষরের কম্বিনেসনে সাজিয়ে দেখি,
কখ, কগ, খগ, খক, গক, গখ, কক, খখ, গগ
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে যে এখানে তিনটি অক্ষর বা চয়েস থেকে রিপিটেসনসহ দুটি অক্ষর বিশিষ্ট কম্বিনেসন গঠন করা যায় ৯টি।
এবারে আমরা পুনরায় রিপিটেসনসহ কম্বিনেসন বের করবার সূত্রটি প্রয়োগ করে পাই,
n^r = ৩^২ = ৩ X ৩ = ৯টি
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে এখানেও আমাদের উপরে বের করা কম্বিনেসন সংখ্যার সাথে সূত্রের সাহায্যে বের করা ফলাফল মিলে গিয়েছে। এখানে মোট অক্ষর বা চয়েস সংখ্যা হচ্ছে n = ৩ এবং যত সংখ্যক অক্ষর ব্যাবহার করে প্রতিটি কম্বিনেসন তৈরি করবো তা হচ্ছে r = ২।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে যে আমরা টাইপিং মেশিনের ৩৮টি বাটনকে এলোমেলোভাবে ৩৮ বার চাপলে সম্ভাব্য যত সংখ্যক কম্বিনেশন আসতে পারে তার সংখ্যা বের করেছি সূত্রের সাহায্যে। কিন্তু ৩৮ বার এর থেকে কম সংখ্যক বার বাটন চাপার ব্যাপারটির তাহলে কি হল?! আসলে আমাদের টাইপিং মেশিনে স্পেসের ব্যাবহার করার কারনে ১০^৭০ সংখ্যক কম্বিনেশনের ভিতরেই অন্যান্য সকল কম্বিনেশনও পেয়ে যাবো। তবে এক্ষেত্রে “I HAVE A PEN” বাক্যটির আশেপাশে স্পেস দিয়ে অন্য কোন সিকোয়েন্সও থাকতে পারে। অর্থাৎ আমরা আমাদের কাঙ্খিত সিকোয়েন্স ঠিকই পাবো তবে তার পাশাপাশি অন্যান্য কিছু কম্বিনেশন বা সিকোয়েন্সও থাকবে। তবে এটা অবশ্যই একটা চিন্তার বিষয় হতে পারে যে কিভাবে ১০^৭০টি [১ এর পরে ৭০টি শূন্য] কম্বিনেশনের মধ্যে “I HAVE A PEN” এর মতো একটি সুনির্দিষ্ট এবং একই সাথে জটিল একটি বাক্য এলোমেলো চাপের ফলে এসে পড়তে পারে?! তবে আমরা ধারনা করতে পারি যে সেই টাইপিং মেশিন হয়তো আরও সরলতর ছিল। তাহলে আমরা একটু দেখি যে ওই টাইপিং মেশিন কি পরিমান সরল হতে পারে! আমরা সরলতার সুবিধার্থে টাইপিং মেশিন থেকে সমস্ত সংখ্যা এবং এন্টার এর বাটনগুলো বাদ দিয়ে দিই।
তাহলে শুধুমাত্র বাকি সকল ইংরেজি বর্ণ এবং স্পেস বাটন সহ মোট বাটন সংখ্যা হয় ২৭টি। সেক্ষেত্রে মোট কম্বিনেশন সংখ্যা হবেঃ
n^r = ২৭^২৭ = ২৭ X ২৭ = ১০^৪৮টি [১ এর পরে আরও ৪৮টি শূন্য]
২৭টি বাটন বিশিষ্ট টাইপিং মেশিনের এই কম্বিনেশন সংখ্যা ৩৮টি বাটন বিশিষ্ট টাইপিং মেশিনের থেকে তুলনামুলকভাবে অনেক কম। কিন্তু স্বাভাবিক দৃষ্টিতে তবুও অনেক বিশাল একটি সংখ্যা। এমনকি এই বিশাল একটি সংখ্যা থেকেও এলোমেলোভাবে কোন অর্থবোধক বাক্য তৈরি হওয়াটা অসম্ভব দেখায়। সেক্ষেত্রে আমরা টাইপিং মেশিনের জটিলতা আরও একটু হ্রাস করতে পারি।
“I HAVE A PEN” এই বাক্যটিতে সর্বমোট ১২টি অক্ষর আছে (স্পেস ও রিপিটেসন সহ)। এখানে হিসাবের সুবিধার জন্য স্পেসকেও একটি নির্দিষ্ট অক্ষর হিসেবে ধরা হয়েছে যেহেতু বাক্যটি তৈরি করার জন্য স্পেস বাটনেও চাপ দেওয়া লাগবে। এখন আমরা দেখবো যে এই ২৭টি বাটন বিশিষ্ট টাইপিং মেশিন দ্বারা ১২ অক্ষর বিশিষ্ট কয় ধরনের বাক্য বা কম্বিনেশন তৈরি করা সম্ভব হতে পারে। এখানে আমরা ধরে নিয়েছি যে আমাদের এলোমেলো সিস্টেম বা টাইপ করার জন্য যে বানর ব্যাবহার করা হয়েছে সেই এলোমেলো সিস্টেম বা বানর কোন কারনে প্রতিবারে ১২টি অক্ষরের সিকোয়েন্স তৈরি করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে!
তাহলে ২৭টি বাটন দ্বারা সৃষ্ট ১২ অক্ষর বিশিষ্ট কম্বিনেশন সংখ্যা –
n^r = ২৭^১২ = ১৫০০৯৪৬৩৫২৯৬৯৯৯১২১টি [১ হাজার ৫০০ কোটি কোটি ৯৪ লক্ষ কোটি ৬৩ হাজার কোটি ৫২৯ কোটি ৬৯ লক্ষ ৯৯ হাজার ১২১]
এবারে আমাদের কাঙ্ক্ষিত কম্বিনেশনের সংখ্যা আগের বের করা দুটি কম্বিনেশন সংখ্যা থেকে অনেক কমে গিয়েছে যার ফলে আমাদের ফলাফলকে এখন আমরা সরাসরি সংখ্যায় প্রকাশ করতে সক্ষম হচ্ছি। কিন্তু সংখ্যায় প্রকাশ করতে পারার ফলে এখন এসকল কম্বিনেশন সংখ্যার বিশালত্ব আরও সহজে উপলব্ধি করতে পারা যাচ্ছে। নিরপেক্ষ ও কমন সেন্স সম্পন্ন যেকোনো মানুষই বলতে বাধ্য হবে যে এতগুলো কম্বিনেশন সংখ্যার মধ্য থেকে একটি সুনির্দিষ্ট ও অর্থবোধক বাক্য এলোমেলো ভাবে তৈরি হওয়াটা অসম্ভব একটি ব্যাপার। তবে সমস্যা নেই, কারন আমরা টাইপিং মেশিনের জটিলতাকে আরও অনেক কমাতে পারবো।
আমরা এখন এমন ১টি টাইপিং মেশিনের কথা চিন্তা করি যেখানে শুধুমাত্র ইংরেজি – A, E, H, I, N, P, V এই কয়েকটি সুনির্দিষ্ট অক্ষর এবং স্পেস বাটনটি আছে। অর্থাৎ এখানে বাটন সংখ্যা হল সর্বমোট ৮টি।
তাহলে ৮টি বাটনকে প্রতিবারে ইচ্ছামতো ১২ বার চাপ দিয়ে সর্বমোট কম্বিনেশন সংখ্যা পাওয়া যাবেঃ
n^r = ৮^১২ = ৬৮৭১৯৪৭৬৭৩৬টি [৬ হাজার ৮৭১ কোটি ৯৪ লক্ষ ৭৬ হাজার ৭৩৬]
যদিও এর আগের হিসাবের তুলনায় অত্যন্ত ছোট একটি সংখ্যা কিন্তু সাধারন দৃষ্টিতে এই সংখ্যাকে কারও পক্ষেই ছোট বলা সম্ভব না। তাহলে এবার আমরা সমগ্র সিস্টেমের জটিলতা আরও কমানোর চেষ্টা করব। কারন একটি টাইপিং মেশিন ব্যাবহার করলে এলোমেলো সিস্টেম থেকে কোন অর্থবোধক বাক্য সৃষ্টি হবার কথা না। এর কারন হল, টাইপিং মেশিনে শুধু ১টি বাক্য তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় বাটনের তুলনায় অনেক বেশি বাটন অর্থাৎ বেশি চয়েস আছে যার কারনে প্রয়োজনের সময় প্রয়োজনীয় বাটনে চাপ পড়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষুদ্র থাকে। এছাড়াও ১টি বাটনে একাধিকবার চাপ পড়ার ফলে রিপিটেসন বা পুনরাবৃত্তিও ঘটে। সমস্যা হল যে প্রয়োজনীয় অক্ষর প্রয়োজনীয় সংখ্যকবার পুনরাবৃত্তি না হওয়া। এসকল কারনেই একটি টাইপিং মেশিন থেকে কখনই একটি বানরের দ্বারা তথা একটি এলোমেলো প্রক্রিয়া দ্বারা একটি সুনির্দিষ্ট অর্থবোধক বাক্য বা সিকোয়েন্স সৃষ্টি করা সম্ভব হবে না। তবে আমরা যদি টাইপিং মেশিনের পরিবর্তে কয়েকটি কাঠের বা প্লাস্টিকের ব্লকের কথা চিন্তা করি তাহলে হয়তো ব্যাপারটি সম্ভব হলেও হতে পারে! “I HAVE A PEN” বাক্যটিতে রিপিটেসন ও স্পেস সহ যে কয়টি অক্ষর আছে আমরা সে কয়টি ব্লকের কথা চিন্তা করি। অর্থাৎ ১টি ‘I’, ১টি ‘H’, ২টি ‘A’, ১টি ‘V’, ২টি ‘E’, ১টি ‘P’, ১টি ‘N’ এবং ৩টি স্পেস ব্লক এর কথা আমরা চিন্তা করি। তাহলে ব্লক সংখ্যা হয় সর্বমোট ১২টি। এখন আমরা এই দেখবো যে এই ১২টি ব্লককে সর্বমোট কতরকমভাবে সাজানো সম্ভব হতে পারে?
আমরা যদি এই ১২টি ব্লক ১টি বানরের হাতে তথা ১টি এলোমেলো সিস্টেমের কাছে সাজানোর জন্য সমর্পণ করে দিই তাহলে সম্ভাব্য মোট কম্বিনেশন সংখ্যা হবেঃ
১২!/(২! X ২! X ৩!) = ১৯৯৫৮৪০০টি [১ কোটি ৯৯ লক্ষ ৫৮ হাজার ৪০০]
এখানে “!” চিহ্নটি হল ফ্যাক্টরিয়াল চিহ্ন। মোট অক্ষর বা ব্লকের সংখ্যা ১২টি হওয়ার কারনে ১২! লেখা হয়েছে। ২টি ‘A’, ২টি ‘E’ এবং ৩টি স্পেসের জন্য অর্থাৎ এসকল রিপিটেসনের জন্য ১২! কে ২! X ২! X ৩! দ্বারা ভাগ দেওয়া হয়েছে।
[বোঝার সুবিধার জন্যঃ ২! = ২ X ১, ৩! = ৩ X ২ X ১, ৪! = ৪ X ৩ X ২ X ১ ইত্যাদি।]
এটি আমাদের হিসাবের মধ্যে আসা সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম সংখ্যা, অথচ কারও পক্ষেই এই সংখ্যাকে ক্ষুদ্র বলে উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয়!!!!! অর্থাৎ আমরা এলোমেলো সিস্টেমের কাছে প্রতিবারে সিকোয়েন্স তৈরির সময়েই অর্থাৎ প্রয়োজনীয় সময়ে শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় উপাদানসমূহ প্রয়োজনীয় সংখ্যায় (অর্থাৎ প্রয়োজনীয় রিপিটেসন সহ) তুলে দিলেও এমনকি সেই অনিয়ন্ত্রিত এলোমেলো সিস্টেমের পক্ষে “I HAVE A PEN” বাক্যটি তৈরি করা অসম্ভব হয়ে দাড়ায়। কারন বিশাল সংখ্যক অসংখ্য চয়েস থেকে ১টি সুনির্দিষ্ট প্যাটার্ন সম্পন্ন সুনির্দিষ্ট অর্থবোধক বাক্য তৈরি করতে হবে। তবে সত্যি কথা হল যে এলোমেলো ও অনিয়ন্ত্রিত পরিবেশে প্রতিবারে সিকোয়েন্স তৈরির সময়ে কেউই সিস্টেমের কাছে এভাবে প্রয়োজনীয় উপাদান প্রয়োজনীয় সংখ্যায় তুলে দেয় না। যদি কোনভাবে এই ঘটনা ঘটে তাহলে সেটি আর অনিয়ন্ত্রিত পরিবেশ থাকে না। এ কারনেই সত্যিকারের হিসাব আসলে ৩৮টি বাটন সমৃদ্ধ টাইপিং মেশিনেও সঠিক হবে না। কারন ১টি পুরনাঙ্গ টাইপিং মেশিন হতে হলে সেখানে ৩৮টি বাটনের বাহিরেও কমা, ফুল স্টপ, ক্যাপস লক, বিভিন্ন নিউমেরিক্যাল অপারেন্ড যেমনঃ প্লাস(+), মাইনাস(-), ইকুএল(=) ইত্যাদি আরও অনেক বাটন থাকে। এ সকল বাটন হিসাব করা হলে এটি চিন্তা করাটা অতি স্বাভাবিক হয়ে যায় যে “I HAVE A PEN” বাক্যটি কোনক্রমেই ১টি এলোমেলো ও অনিয়ন্ত্রিত সিস্টেমের কাছ থেকে বা ১টি বানরের কাছ থেকে আসা সম্ভব নয়। তাছাড়াও একটি টাইপিং মেশিন থেকে সত্যিকার অর্থে অসীম সংখ্যক কম্বিনেশন তৈরি করা সম্ভব। ব্যাপারটি নির্ভর করে সময় আর বাটন প্রেসের পরিমানের উপরে। এই অসীম সংখ্যক কম্বিনেশন থেকে একটি জটিল, সুনির্দিষ্ট ও অর্থবোধক বাক্য যা কিনা পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণীদের মনের ভাব প্রকাশ করতে পারবে সেরকম ১টি বাক্য একটি এলোমেলো ও অনিয়ন্ত্রিত পরিবেশ থেকে তৈরি হবার চিন্তা করাটাও বোকামি। এক্ষেত্রে স্পেসিফাইড কমপ্লেক্সিটির জন্য ডেম্বস্কির দেওয়া উদাহরনটি অর্থাৎ সেক্সপিয়ারের যেকোনো ১টি সনেট যা কিনা “I HAVE A PEN” বাক্যটির থেকে হাজার হাজার গুন বেশি জটিল ও সুনির্দিষ্ট তাতো তৈরির প্রশ্নই আসে না।
আশা করি সকলের পক্ষেই এখন বোঝা সম্ভব হয়েছে যে কেন স্পেসিফাইড কমপ্লেক্সিটি বা সুনির্দিষ্ট জটিলতা ১টি অনিয়ন্ত্রিত ও এলোমেলো সিস্টেম থেকে তৈরি হওয়া সম্ভব নয়। যেহেতু সেক্সপিয়ারের ১টি সনেট এভাবে আসা সম্ভব নয় সেখানে কিভাবে তার থেকেও আরও কোটি কোটি গুন বেশি জটিল এবং একই সাথে সুনির্দিষ্ট জীবদেহ বা কোন একটি অঙ্গাণু এলোমেলো ও অনিয়ন্ত্রিত ১টি সিস্টেম থেকে তৈরি হবার কল্পনা আমরা করতে পারি?!?!?!?!
বর্তমান পৃথিবীর অসংখ্য জীবদেহের প্রত্যেকটির বিশাল আকারের জটিলতা এবং প্রচণ্ড রকমের সুনির্দিষ্টতা অবশ্যই কোন এলোমেলো ও অনিয়ন্ত্রিত সিস্টেম থেকে আসা সম্ভব নয়। এদের এই সুনির্দিষ্ট জটিলতা বা স্পেসিফাইড কমপ্লেক্সিটি একজন সূমহান ডিজাইনারের অস্তিত্বের দিকেই ইঙ্গিত দেয়।
সহায়ক তথ্যসূত্রসমূহঃ
১) http://en.wikipedia.org/wiki/William_Dembski
২) http://en.wikipedia.org/wiki/Specified_complexity
৩) উচ্চ মাধ্যমিক বীজগণিত ও ত্রিকোণমিতি; নবম সংস্করণ; লেখক – এস, ইউ, আহাম্মদ (ষষ্ঠ অধ্যায়ঃ বিন্যাস ও সমাবেশ)
৪) উচ্চ মাধ্যমিক বীজগণিত ও ত্রিকোণমিতি; দ্বাদশ সংস্করণ; লেখক – আফসার উজ-জামান (ষষ্ঠ অধ্যায়ঃ বিন্যাস ও সমাবেশ)