সেদিন ছিল পহেলা ফাল্গুন, আমরা কয়েকজন মানুষ মিলে গিয়েছিলাম নোয়াখালী অফিসের কাজে। সেখানেই গল্পটা শোনা। গল্প-এর মূল চরিত্র এ ছিল হাসিব নামের একটি ছেলে আর অন্য প্রান্তে মৌরি নামের এক মেয়ে। তারা দুজন সম্পর্কে আত্মীয় হয়।
গল্পের শুরু ছিল প্রায় ১২ বছর আগে। তখন তারা দুজনই থাকতো ফেনীতে। আত্মীয় হওয়ায় মাঝে মাঝেই তাদের দেখা হতো। যেহেতু বয়স কম, তাই তারা একসাথে খেলাধুলা করতো, মজা করতো। এর বাইরে তাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক তখন তৈরী হয়নি। হাসিব আবার অন্তত দূরন্ত ছেলে ছিল। তাই এক গ্রীষ্মের দুপুরে তার বাবা তাকে পাঠিয়ে দেয় ঢাকায়, তার বড় ভাইয়ের কাছে। মূল উদ্দেশ্য ছিল বড় ভাইয়ের শাসনে সে যেন ভালো করে পড়াশোনা করে। দিন যায়, মাস যায়, এক সময় বছরও যায়। হাসিব ভাইয়ের তত্ত্বাবধায়নে বেশ ভালোই রেজাল্ট করে। তাই পুরষ্কার হিসাবে তাকে ফেনীতে পাঠানো হয় এক মাসের জন্য। হাসিবও বেশ খুশি, ফেনীতে গিয়ে সে তার সব বন্ধুদের ঢাকার গল্প বলবে। সবই ঠিক ছিল, কিন্তু মৌরিকে সে আর খুঁজে পায় না। বাবাকে জিজ্ঞাস করে জানতে পারে, ওরা পুরো পরিবার চট্রগ্রামে চলে গেছে। ওখানে নাকি মৌরির বাবার ব্যবসা আছে। এটা শুনে হাসিব এর তেমন কষ্ট লাগে না। কিছুদিন পর ছুটি শেষ হলে, হাসিবও ঢাকায় চলে যায়।
এরপর মাঝে ১০ বছর সময় চলে যায়। হাসিব এসএসসি, এইচএসসি পাশ করে ফেলে। বেশ ভালো রেজাল্ট এর সহযোগেই পাশ করে। কিন্তু বিধিবাম, যখন তার আনন্দ করার কথা, তখনই, রেজাল্ট এর এক সপ্তাহ পরে, হাসিব এর বাবা মারা যায়। তার দাফন আর মিলাদ এর কাজ এর জন্য হাসিব আবার ছুটে যায় ফেনীর পথে, ভাই আর ভাবীর সাথে। এইখানেই মিলাদ এর দিন এক সুন্দর মেয়ের সাথে দেখা হয় হাসিব এর। প্রথম দেখাতেই হাসিব প্রেম এ পড়ে যায়। কিন্তু যেহেতু বাবার মৃত্যু হয়েছে মাত্র, সেজন্য হাসিব আর বেশিদূর যায় না। সব কাজ যখন শেষ হয়ে যায় ও আবার ঢাকায় ফিরে যায়। ঢাকায় ফিরে পড়ালেখায় মনোযোগ দেয়, যাতে করে ভালো এক প্রতিষ্ঠান এ ভর্তি হতে পারে। কিন্তু সারাক্ষন তার মনে সেই মেয়ের কথা ঘুরা ফিরা করে। এই কারনেই হয়তো, তার স্থান হয় ডিগ্রি কলেজ এ। ভর্তির পর ক্লাশ শুরু হতে দেরী বলে, হাসিব আবার ফেনী চলে আসে।
এরপর খোঁজ নিয়ে জানতে পারে ঐ মেয়ে তাদের এলাকাতেই থাকতে এসেছে এসএসসির পরীক্ষার পরের ছুটিতে। সাহস করে সে একদিন তাদের বাসাতে চলেও যায়। গিয়েই দেখে যে মেয়ের মা কেন জানি তার কাছে খুব পরিচিত লাগছে। বাসায় এসে হাসিব তার মাকে জিজ্ঞাস করলে সে জানতে পারে যে মেয়ে আর কেউ না, সেই মৌরি। তখনই সে আবার দৌড়ে চলে যায় তাদের বাসায়। এবার গিয়ে আর দূর থেকে দেখা নয়, একেবারে বাসায় উপস্থিত। মৌরির পরিবারও তাকে বরণ করে নেয়। এখন তো যুগ পাল্টিয়েছে, তাই হাসিব এরও মোবাইল আছে, মৌরিও আছে। এক সময় তারা তাদের নাম্বার অদল বদল করে নেয়। এরপর সেই গদবাঁধা কাহিনি, ছেলে মেয়ে দুজন প্রেম এ জড়িয়ে পড়ে। অবশ্য বেশিদিন টিকে নাই সেই প্রেম, ১ বছরের মাথায় তা ভেঙ্গে যায়। কারণ, মেয়ে তার মার কাছ থেকে জানতে পারে যে, তাদের পরিবার হাসিবকে জামাই হিসাবে মেনে নিবে না। হাসিবও তখন ভালো ছেলের মতো সব দাবী দাওয়া ছেড়ে দিয়ে দূরে চলে যায়।
এর এক বছরের মাথায়, নোয়াখালীতে বসে আমি এই গল্প শুনি স্বয়ং হাসিব এর মুখে। আমরা তখন নোয়াখালি থেকে ঢাকায় যাবার জন্য বাসের অপেক্ষা করছিলাম। কিছুটা জোড় করেই আমি হাসিবকে চিটাগাং এর বাসে তুলে দেই। পরের দিন, সকাল এ হাসিব মৌরির কলেজ এর গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে। মৌরি হয়তো সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে মনে করবে গত বছরের ভ্যালেন্টাইন ডে এর কথা। সেদিন হাসিব আর মৌরি সারাদিনই ঘুরেছিল এক সাথে। তারপর হয়তো ভারাক্রান্ত মনে মৌরি তৈরি হয়ে কলেজের পথে পা বাড়াবে। যেহেতু মন খারাপ, তাই তার মনোযোগ থাকবে না রাস্তায়, তার মনোযোগ থাকবে অতীতে। এজন্যই গেটের পাশে দাঁড়ানো হাসিবকে সে হয়তো দেখতে পাবে না। কিন্তু যখন হাসিব তাকে পিছন থেকে ডাক দিবে, এবং সে ঘুরে দাঁড়িয়ে হাসিবকে দেখবে, তখন তার চেহেরায় যে হাসির রেখা দেখা যাবে তা চিন্তা করতে করতেই আমি ঘুমিয়ে পড়ি।
ঘুম থেকে উঠে দেখি বাস ঢাকায় পৌছে গেছে, তখন আমি হাসিবকে বিদায় জানিয়ে নিজের বাসস্থলের দিকে পা ফেলি আর মনে করি, চিটাগাং এর বাসে উঠলে হাসিব এর মুখ হয়তো গোমড়া না হয়ে হাস্যময় থাকতো।
বিদ্রঃ বাস্তব ঘটনা।