আগের পর্ব সীরাতুন্নবী (সাঃ) ৫২, তায়েফে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) (২)
সূরা আহকাফে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ “স্মরন করো, আমি তোমার প্রতি আকৃষ্ট করেছিলাম একদল জীনকে, যারা কোরআন পাঠ শুনছিলো। যখন ওরা তার কাছে উপস্থিত হলো, ওরা একে অপরকে বলতে লাগলো, চুপ করে শ্রবন করো। যখন কোরআন পাঠ সমাপ্ত হলো, তখন ওরা তাদের সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে গেল এক একজন সতর্ককারীরুপে। এমন এক কিতাবের পাঠ শ্রবন করেছি যা, অবতীর্ণ হয়েছে মুসা(আ) এর উপর। এটি পুর্ববর্তী কিতাবকে সমর্থন করে এবং সত্য ও সরল পথের দিকে পরিচালিত করে। হে আমাদের সম্প্রদায়, আমাদের দিকে আহবানকারীর প্রতি সাড়া দাও এবং তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করো। আল্লাহ তাআলা তোমাদের পাপ মাফ করে দিবেন এবং মর্মন্তুদ শাস্তি থেকে তোমাদের রক্ষা করবেন।“ {২৯-৩১,৪৬}
সূরা জীনে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ “ বল আমার প্রতি ওহী প্রেরিত হয়েছে যে, জীনদের একটি দল মনযোগ সহকারে শ্রবণ করেছে এবং বলেছে, আমরাতো এক বিস্ময়কর কোরআন শ্রবণ করেছি, যা সঠিক পথ নির্দেশ করে, ফলে আমরা এতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি। আমরা কখনো আমাদের প্রতিপালকের কোন শরীক স্থাপন করবো না।“ সূরা জীন এর পনেরটি আয়াত পর্যন্ত এর বর্ণনা রয়েছে।
উল্লেখিত আয়াত সমূহের বর্ণনা ভঙ্গি থেকে বুঝা যায় যে, নবী করিম (সাঃ) জিনদের আসার কথা প্রথম দিকে জানতেন না। কোরআনের আয়াতের মাধ্যমে তাঁকে জানানোর পর আল্লাহর রসুল (সাঃ) এ সম্পর্কে অবহিত হন। কোরআনের আয়াত দ্বারা বুঝা যায় যে, এটা ছিল জীনদের প্রথম আগমণ। বিভিন্ন হাদিস থেকে জানা যায় যে, পরবর্তী সময়ে তাদের যাতায়াত চলতে থাকে।
জীনদের আগমণ এবং ইসলাম গ্রহণ প্রকৃত পক্ষে আল্লাহর পক্ষ থেকে ছিল দ্বিতীয় সাহায্য। আল্লাহর অদৃশ্য ভান্ডার থেকে তিনি এ সাহায্য লাভ করেন। এ ঘটনার বর্ণনা সম্পর্কিত অন্যান্য আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় রাসুলকে দ্বীনি দাওয়াতের সাফল্যের ব্যাপারে সুসংবাদ দিয়েছেন এবং এ কথা সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন যে, পৃথিবীর কোন শক্তিই দ্বীন ইসলামের দাওয়াতের সাফল্য ও অগ্রগতির পথে অন্তরায় হয়ে টিকতে পারবে না। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন, “ কেউ যদি আল্লাহ তাআলার দিকে আহবানকারীর ডাকে সাড়া না দেয়, তবে সে পৃথিবীতে আল্লাহর অভিপ্রায় ব্যর্থ করিতে পারিবে না এবং আল্লাহ ছাড়া তাদের কোন সাহায্যকারীও থাকবে না। ওরাই সু-স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে রয়েছে। {৩২,৪৬}
আল্লাহ তাআলা কাফেরদের উক্তির কথা বলেনঃ “ আমরা বুঝতে পেরেছি যে, আমরা আল্লাহকে জমিনে অসহায় করতে পারবো না এবং আমরা পালিয়ে গিয়েও তাকে অসহায় করতে পারব না। {১২,৭২}
এই সাহায্য ও সু-সংবাদের সামনে তায়েফের খারাপ ব্যবহারজনিত দুঃখ-কষ্ট, মনের কালো মেঘ দুর হয়ে গিয়েছিল। আল্লাহর রসুল (সা) দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলেন যে, মক্কায় তাঁকে ফিরে যেতে হবে এবং নতুন উৎমাহ উদ্দীপনার সাথে দ্বীনের দাওয়াত দিতে হবে। এ সময় হযরত যায়েদ ইবনে হারেসা (রা) বলেন, হে আল্লাহর রসুল (সাঃ) আপনি কি করে মক্কায় যাবেন ? মক্কার অধিবাসীরাতো আপনাকে মক্কা হতে বের করে দিয়েছে। তিনি বললেন, হে যায়েদ, তুমি যে অবস্থা দেখেছো, এ অবস্থা থেকে উত্তরণের কোন উপায় আল্লাহ রহমানুর রহিম বের করে দিবেন। আল্লাহ সুবহানু তাআলা তাঁর দ্বীনকে সাহায্য এবং তাঁর নবীকে জয়যুক্তর করবেন।
রসুলুল্লাহ (সা) নাখলা থেকে রওনা হয়ে মক্কার অদুরে হেরা গুহায় অবস্থান করলেন। সেখান থেকে খাজায়া গোত্রের একজন লোকের মাধ্যমে আখনাস ইবনে শোরাইককে এ পয়গাম পাঠালেন যে, আখনাস যেন তাঁকে আশ্রয় দেয়। আখনাস এ কথা বলে অক্ষমতা প্রকাশ করলো যে, আমিতো মিত্র পক্ষ, মিত্র পক্ষতো কাউকে আশ্রয় দেয়ার মত দায়িত্ব নিতে পারে না। রসুলুল্লাহ (সা) এরপর সোহায়েল ইনে আমরের কাছেও একই পয়গাম পাঠালেন। কিন্ত সেই লোকও এই বলে অক্ষমতা প্রকাশ করলো যে, বনু আমরের দেয়া আশ্রয় বনু কা’ব এর উপর প্রযোজ্য নয়। এরপর রসুলুল্লাহ (সা) মোতআ’ম ইবনে আদির কাছে পয়গাম পাঠালেন। মোতআ’ম বললেন, হ্যাঁ আমি রাজি আছি। এরপর তিনি অস্ত্র সজ্জিত হয়ে নিজের সন্তান এবং গোত্রের লোকদের ডেকে একত্রিত করলেন। সবাই একত্রিত হওয়ার পর বললেন, তোমরা অস্ত্র সজ্জিত হয়ে কা’বা ঘরের সামনে যাও। কারণ আমি রসুলুল্লাহ (সা)কে আশ্রয় দিয়েছি। এরপর মোতআ’ম রসুলুল্লাহ (সা) কে খবর পাঠালেন যে, আপনি মক্কার ভিতরে আসুন। রসুলুল্লাহ (সা) খবর পাওয়ার পর যায়েদকে সঙ্গে নিয়ে মক্কায় প্রবেশ করলেন। মোতআ’ম ইবনে আদি তাঁর সওয়ারীর উপর দাড়িয়ে ঘোষনা করলো যে, কোরাইশের লোকেরা শুনো, আমি মোহাম্মদ (সা) কে আশ্রয় দিয়েছি। কেউ যেন এরপর তাঁকে বিরক্ত না করে। রসুলুল্লাহ (সা) হাজরে আসওয়াদ চুম্বন এবং দু’রাকাত নামাজ আদায় করলেন। নামাজ আদায়ের পর তিনি নিজের ঘরে ফিরে গেলেন। এসময় মোতআ’ম ইবনে আদি এবং তাঁর সন্তানেরা অস্ত্র সজ্জিত হয়ে রসুলুল্লাহ (সা) কে ঘীরে রাখলেন। আল্লাহর রসুল (সা) ঘরে ফিরে যাওয়া পর্যন্ত তারা তাঁর সঙ্গে ছিলো।
বলা হয়ে থাকে যে, এ সময় আবু জেহেল মোতআ’মকে জিজ্ঞাসা করেছিলো, তুমি শুধু তাঁকে আশ্রয় দিয়েছো, না তাঁর অনুসারী অর্থ্যাৎ মুসলমানও হয়ে গিয়েছো ? মোতআ’ম বললেন, আমি শুধু আশ্রয় দিয়েছি। এতে আবু জেহেল বললো, তুমি যাকে আশ্রয় দিয়েছো, আমরাও তাকে দিলাম।
রসুলুল্লাহ (সা) মোতআ’ম ইবনে আদীর এ উপকারের কথা কখনো ভুলেননি। বদরের যুদ্ধের পর মক্কার কাফেররা বহু সংখ্যক বন্দি হয়ে আসার পর কয়েকজন বন্দী মুক্তির সুপারিশ নিয়ে মোতআ’মের পুত্র হযরত হোবায়ের (রা) রসুলুল্লাহ (সা) এর কাছে হাজির হলে তিনি বলেছিলেন, মোতআ’ম ইবনে আদী যদি আজ বেঁচে থাকতো এবং আমার কাছে এসব দুর্গন্ধময় লোকদের ব্যাপারে সুপারিশ করতো, তবে তার খাতিরে আমি এদের সবাইকে মুক্ত করে দিতাম।