পহেলা বৈশাখ হলো বাঙালির নববর্ষ। নতুন বছর শুরু হওয়ার প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পথ বেয়ে বাঙালির পথচলার একটি প্রেক্ষণবিন্দু এই দিনটি। হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায় সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের বিচিত্রতা নিয়ে এই দিনটিকে যাপন করে আসছে বহু বর্ষব্যাপী। ঐতিহ্যিক উপকরণের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে নয়; বরং বছরের প্রথম দিনে বাঙালির আত্মজাগরণের ইতিবাচকতা নির্দেশের প্রেক্ষাপটে আমার বক্তব্যকে এ প্রবন্ধে উপস্থাপন করব।
সমাজ-রাজনীতি-সংস্কৃতি-ধর্ম-দর্শন ও দৈনন্দিন জীবনাচারের ক্ষেত্রে আমাদের যে বহমানতা, বাংলা বছরের প্রথম দিনে সে বিষয়ে সচেতন প্রণোদনা নিয়ে আমাদের বিশেষভাবে ভাবতে হবে। জাতি হিসেবে আমাদের অবস্থানকে বিশ্বমাঝে গৌরবের সঙ্গে তুলে ধরার জন্যে আমাদের এই দিনে বিশেষভাবে চিন্তা করে সারাবছর সে অনুযায়ী কাজ করে যেতে হবে।
ইরানীরা নওরোজকে তাদের বছরের প্রথমদিন হিসেবে খুব জৌলুসের সঙ্গে পালন করে। জাতীয়ভাবে আমরা তা পালন করতে পারি— এটি অবশ্যই আশার কথা। তবে এই আশা তখনই একটি বিশিষ্টতা পাবে— যদি আমরা আমাদের জীবনগত শপথকে এর মাধ্যমে ভবিষ্যতের দিকে সঞ্চালিত করে দিতে পারি।
আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে কিছু অস্থিরতা রয়েছে। গ্রামীণ ও শহুরে সমাজ-সংগঠনের মধ্যে এমন একটি ভারসাম্যপূর্ণ প্রাজ্ঞতা ও ব্যবস্থাকে বিশেষ করে ব্যক্তির বোধকে মহীয়ান উচ্চতায় নিয়ে যেতে হবে— যাতে সমাজ-সাংস্কৃতিক ইতিবাচকতার আবহ বিরাজিত থাকে।
সমাজের মধ্যে অনাচার, অবক্ষয়, খুন ও অসহিষ্ণুতা বিরাজমান— মানুষ কেন স্বার্থপরতা ও আত্মউন্নয়নে এত বেচাইন হয়ে যাবে যে— অন্য কারো জীবনের ইতিবাচকতাকে সে মূল্য দেবে না— এমনটি তো হওয়া উচিত নয়। নববর্ষে আমাদের সহিষ্ণু ও মানবিক হওয়ার শপথ নিতে হবে।
হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান প্রভৃতি বিভিন্ন ধর্মের লোক বাংলাদেশে বসবাস করে। প্রতিটি মানুষই সে যে ধর্মেরই হোক না কেন— যেহেতু একই স্রষ্টার সৃষ্টি; সেজন্যে ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে প্রতিটি ধর্মের মানুষের জন্য শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসা প্রদর্শনের নিশ্চয়তার শপথ আমাদের এই দিনে নিতে হবে। যে যে যার যার ধর্ম পূর্ণ স্বাধীনতার মাধ্যমে পালন করবে এবং মানুষের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ধর্মের কারণে যাতে সংকীর্ণ হয়ে না যায়; বরং অন্য ধর্মের মানুষ হওয়ার কারণে সে যাতে আমাদের কাছে বিশেষ মনোযোগ ও শ্রদ্ধার পাত্র হয়— সে বিষয়ে আমাদের সচেতন হতে হবে। তাহলেই সাংস্কৃতিক উত্সবের সময়ে বাংলাদেশে আত্মঘাতী বোমা হামলার মতো ঘটনা আর দ্বিতীয়বার ঘটবে না।
রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আমাদের বিশ্বমান অর্জন করতে হবে। বছরের প্রথমদিনে এই বিষয়েও রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক কর্মীদের ইতিবাচকতা ও সহিষ্ণুতার শপথ নিতে হবে।
রাজনীতি আসলে একটি দেশের উন্নয়নের নীতি-নির্ধারণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রভাবক ভূমিকা পালন করে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে চিন্তার মতানৈক্য থাকতে পারে; আদর্শগত বিরোধ থাকতে পারে— তবে সহিষ্ণুতা ও দূরদর্শিতার মাধ্যমে সে বিষয়গুলোকে চালিত করতে হবে। রাজনৈতিক নেতারা যদি একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সহিষ্ণু হন— তবে দেশের অনেক সমস্যারই সমাধান হতে পারে। রাজনৈতিক খণ্ডিত ও বিভাজিত স্বার্থ সংশ্লিষ্টতায় দেশকল্যাণের বোধকে নেতিবাচকতায় ম্লান করে দেয়া যাবে না। প্রতিটি রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী যদি দেশকে তাদের মা মনে করেন; তবে মায়ের মান রক্ষা ও মাতৃ-উন্নতির ব্যাপারে অবশ্যই তাদের মনে চেতনা জাগবে। দেশমাতাকে ভালোবাসার শপথ নববর্ষে গ্রহণ করতে হবে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যাতে অর্থনীতি ও প্রযুক্তিতে উঁচু অবস্থানে যেতে পারে— সে ব্যাপারেও রাষ্ট্রিক প্রচেষ্টাকে চালনা করতে হবে। জঙ্গিত্বের জন্য বাংলা ভাই ও তার সহযোগীদের ফাঁসির রায় কার্যকর করেছিল
বাংলাদেশ। ইরান ও আফগানিস্তানের নিরপরাধ শিশু নারীদের হত্যাকারী আমেরিকা জঙ্গিপনা না করার ব্যাপারে বাংলাদেশের বাংলা ভাইয়ের ফাঁসির কারণে আমাদের দেশ থেকে শিক্ষাগ্রহণ করতে পারে। বাংলাদেশ যে একটি মডারেট ও মধ্যপন্থি ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিকে গুরুত্ব দেয়া একটি রাষ্ট্র— এই বিষয়টিকে বিশ্ব মিডিয়ায় প্রতিষ্ঠা দেয়ার শপথও নববর্ষে আমাদের গ্রহণ করতে হবে। তাহলেই নববর্ষ-উদ্যাপন আমাদের জন্য সুফল বয়ে আনবে।
↧
শুভ হোক বাংলা নববর্ষ
↧