ছাতার কবলে পর্ব -১
ছাতার কবলে পর্ব- ২
ছাতার কবলে পর্ব-৩
আগের পর্বের শেষের কিছু অংশ হতে..
রূপা ছুটে এসে গলা চড়িয়ে, ‘কী হলো?’ কোনমতে সামলে নিয়ে নয়ন, ‘না, কিছু না। তুমি ভেতরে যাও’
‘তুই থেকে তুমি? হঠাত!’ বিস্মিত রূপা ফিক করে হেসে ফেলে। উফফ, এ হাসিটাও কি সুন্দর! অস্বস্তিতে খাবি খেতে খেতে নয়ন বলে, ‘ হ্যাঁ, সে -ই ভালো! কোনো অসুবিধা?’
‘ না, আমার আপত্তি নেই! এসো, ভিতরে এসো। চা করেছি, খাবে এসো’ মৃদু গা-জ্বালানো হাসিটা বন্ধ করছে না রূপা। নয়ন ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে – কেন এমন হচ্ছে?
পর্ব -৪
ঘরের দাওয়ায় একটা মাদুর পেতে বসেছে নয়ন। এক ধামা ঝাঁঝালো আচারের তেল মাখানো মুড়ি কাঁচা লঙ্কা দিয়ে আনমনে সাবড়ে দিচ্ছে। মনে এযাবৎ ঘটা যত অসংলগ্ন সব ঘটনার ঝড়। কোনো কূলকিনারা পাচ্ছে না! এই সময় রূপা এসে বসলে নয়ন ফট করে প্রশ্নটা করেই ফেললো, ‘বাড়িতে অন্য কাউকে দেখছি না। আর সবাই কোথায়? একা থাকো নাকি?’
এ কথার সরাসরি জবাব দেয় না রূপা। কেমন হেঁয়ালি চোখে চেয়ে থাকে। মুখে ছমছমে একটা হাসি, ‘কেন, শুধু আমাকে ভালো লাগছে না? আর কাকে চাই তোমার?’ কী কথার কী জবাব! বিব্রত হয়ে যায় নয়ন।
‘বারে, সেটা বলেছি কখন? রূপা, তোমার অনেক পরিবর্তন হয়েছে – সেটা কি জানো?’
‘কী রকম?’ মিট মিট হাসে রূপা।
‘তুমি কখনোই এভাবে কথা বলতে না! অন্তত আমার সাথে। পুরো কলেজ লাইফটাই তো ঝগড়া করে কাটিয়ে দিয়েছিলে। আমাকে একদম দেখতেই পারতে না। সেই আমাকেই কিনা এত দিন বাদে...’
‘ তাই বুঝি? দেখতেই পারতাম না!!’
‘ নয়? এত ভুলোমন তো নই!’ মাথা নাড়ে নয়ন।
‘ সেটাই। এই বুঝি বুঝেছিলে? বোকার হদ্দ কোথাকার – আমারি ভুল!’ রূপা কেমন আনমনা হয়ে যায়। আবছা আলোয় ভুলও হতে পারে। আকস্মিক বিষাদে থমথম করে রূপার সুন্দর মুখশ্রী। তবে কী? বহুদিনের জমানো অনিষ্পন্ন আশঙ্কাটা আবার স্বেচ্ছা-আরোপিত বিস্মৃতি ভেদ করে উঠে আসে। হতভম্ব মুখে বসে থাকে নয়ন। মুড়িটা বড্ড বিস্বাদ লাগতে থাকে। সে নিজে কেন এতো দুর্বোধ্য!
ঝড় থেমে গেছে বেশ খানিক আগে। বৃষ্টি ধোয়া আকাশে এখন পূর্ণ চাঁদের রাজত্ব। থমথমে মুখের রাগী মেঘেদের চোখ রাঙ্গানি সত্বেও চাঁদটা নির্লজ্জ আলো বিলাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে শিশুর মত খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে রূপা। তারপর অকস্মাৎ নয়নের হাতটা টেনে ধরে, ‘ এই দেখো, কী সুন্দর চাঁদ উঠেছে!’
‘কাজ নেই আমার চাঁদ দেখে। তুমি –ই দেখো, যাও’
‘আহ, এমন করো কেনো? এসোই না একটু? আর হয়তো কখনো এ সময় আসবে না!’
অগত্যা নয়নকে উঠতে হলো। এই অনুনয় ফেলার মত নয়! উঠোনে দুই সুপারি গাছের ফাঁকে রুপার থালার মত চকচকে চাঁদ দেখে নয়ন হকচকিয়ে গেলো। এত সুন্দর জ্যোৎস্না সে তার জীবনে দেখেছে কিনা সন্দেহ! চারপাশ কোমল আলোয় ভেসে যাচ্ছে। তবে আকাশের ঐ চাঁদের থেকে কোনো অংশেই কম যাচ্ছে না পাশেই দাঁড়ানো মর্ত্যের চাঁদ – রূপা। পেলব আলো চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে রূপার মুখমণ্ডলে – ঠোঁটে, মসৃণ গ্রীবায় আর আমন্ত্রণের আবেগে কাঁপা সুগঠিত বুকে! নয়নের কেমন পাগল পাগল লাগতে থাকে...অদ্ভুত এক ঘোরে চোখ বুঝে থাকা রূপাকে বুকের মাঝে পিষে ফেলতে ইচ্ছে হয়। মন্ত্রমুগ্ধের মত এগুতে গিয়ে হোঁচট খায়। কে যেন বুকের ভেতরে বলে ওঠে – এ সত্যি নয় হে – টুউউ গুড টু বি ট্রু! এ নিশ্চয়ই স্বপ্ন – প্রায় সত্যের মত স্বপ্ন। তার মত হতভাগ্যের এ যে মানায় না! নয়ন নিজেকে সামলায়।
চোখ মেলে নয়নকে আপন মনে বিড়বিড় করতে দেখে হেসে ফেলে রূপা, ‘মন্ত্র পড়ছো নাকি? রূপা-তাড়ন মন্ত্র? ভয় পেয়েছো? হি হি হি। যত যা –ই করো, আমার হাত থেকে আজ তোমার নিস্তার নেই!’
‘মানে? ভয় পাবো তোমাকে? কেন – ভূত নাকি তুমি? হা হা হা’
‘ নই? হতেও তো পারি। তবে, উঁহু ভূত নয় – পেত্নী হতে পারি’
‘তাই নাকি! তবে, এমন সুন্দরী পেত্নীর সঙ্গ পাওয়াও যে বড় আনন্দের!’
‘ বাহ, বেশ বোল ফুটেছে দেখছি’ রূপা ফোঁড়ন কাটে।
‘আচ্ছা, ফাজলামি থাক। কী জানো, আজকে এই হঠাত করে তোমার সাথে দেখা হয়ে যাওয়া। কাকতালীয় নয়? তবে, দেখাই যখন হয়েছে, তখন একটা কথা বলি – সেদিনের জন্য আমি ক্ষমা চাইছি। সেই যে রাগ করে বৃষ্টি মাথায় নেমে গেলে...আর দেখাই হলো না! কত খুঁজেছি, কিন্তু তোমরা এলাকা ছেড়েই চলে গেলে – ঠিকানাও রেখে যাও নি! বলা হয়নি আমি অনুতপ্ত হয়েছিলাম – এখনো আছি’
‘ ও মা, সেই কথা তুমি এখনো মনে রেখেছো! আজ এত দিন পর আমার আর তেমন কোনো অনুযোগ নেই। আমার দোষও তো কম ছিলো না! সামান্য একটা প্রজেক্ট নিয়ে যা করেছিলে? হা হা হা। আচ্ছা, তুমি কি এখনও সেইরকম নীতির গোঁয়ার-গোবিন্দ আছো?’
সন্তর্পনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নয়ন। হায় রে নীতি! বাবা আজ বেঁচে থাকলে কী দুঃখটাই না পেতেন। অভাবের তাড়নায় আজ চুরিটাও করে ফেলেছিলো। নিজের প্রতি ঘেন্নায় মাথা নীচু করে ফেলল। ভাগ্যিস আলো- আঁধারি চারিদিকে, নইলে আত্মদহনের অশ্রুটুকু এই মেয়েটা দেখেই ফেলতো। তাড়তাড়ি সামলে নিয়ে একটু কেশে গলাটা পরিষ্কার করে, ‘রূপা, নীতির আর কিছুই অবশিষ্ট নেই আমার মাঝে! আজই চুরি করে ধরা পড়ে পালাচ্ছিলাম। তারপর ছাতাটা...এবং কীভাবে কীভাবে যেন এখানে চলে এলাম। আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি রূপা, আমার সব জলে ভেসে গেছে’ দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলে নয়ন।
রূপা কোনো কথা বলতে পারলো না। কেবল বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইল।
চলবে....