মানুষ ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন দেখে, আমি এই হবো, আমি সেই হবো। আমিও তার ব্যতিক্রম ছিলাম না। আমারো কিছু স্বপ্ন ছিলো। তবে হ্যা, অন্য ছেলেমেয়েদের মত কমন স্বপ্ন আমার ছিলো না। প্রায় সব ছোট ছেলেমেয়েকেই, ‘বড় হয়ে তুমি কি হবে?‘ জিজ্ঞেস করলে উত্তর আসে, আমি ডাক্তার হব অথবা আমি ইঞ্জিনিয়ার হবো, আর কেউ কেউ বলে আমি পাইলট হবো। আমার আম্মাও এই ধরনের উত্তরের আশা নিয়েই হয়তো আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন একই প্রশ্ন। আমি তখন অনেক ছোট। মনেহয় ক্লাস থ্রি তে পড়ি। আমি উত্তর দিলাম, ‘আম্মা, আমি বাসের হেলপার হবো।’ উত্তর শুনে আম্মা হতবাক সেই সাথে হতাশ। ছেলে বলে কি?!! আমারই বা কি দোষ বলেন? লোকাল বাসে করে স্কুলে যাবার সময়, হেলপারদের বাসের গেটে স্পাইডারম্যানের মত ঝোলার থ্রীলিং সিন দেখলে কার না হেলপার হতে ইচ্ছে করবে? তার উপর কি দারুনভাবে বাসের গায়ে ধাপধাপ ধাপধাপ আওয়াজ করে রাস্তার রিক্সাগুলোকে বলতে থাকে, ‘ঐ রিক্সা বালা বালা’। আবার প্রাইভেট কার দেখলে ড্রাইভারকে সাবধান করার জন্য বলে ওঠে, ‘ওস্তাদ বায়ে পেলাস্টিক’। আবার কোন মহিলা বাস থেকে নামতে চাইলে বলে ওঠে, ‘বাস থামবো। লেডিস নামবো।’ এত দারুণ দারুণ ডায়ালগে ভরা থ্রীলিং লাইফ দেখে দেখে স্কুলে যাওয়া আসা করতে করতে নিজের জীবনের লক্ষ্য বানিয়ে ফেলেছিলাম বাসের হেলপার হওয়ার।
আরো কিছুদিন পরে আরেকটু বড় হই আমি। ক্লাস ফাইভে ছিলাম মনেহয়। একদিন স্কুলে সুদকশার জঘন্য পাটিগণিত ভুল করলাম। খলিল স্যার ধরে দিলো উত্তম-মাধ্যম। বেতের বাড়ি খেয়ে হাতের তালু হয়ে গেলো আলু। মেজাজ-মর্জি চরম খারাপ। সেই সময় স্যার ছিলো এইচ.এস.সি পাশ। ততক্ষণাত জীবনের লক্ষ্য ঠিক করে ফেললাম। কোন মতে এইচ.এস.সি পাশ করবো, আর তারপর প্রাইমারী স্কুলের টিচার হবো। আর পোলাপান পড়া না পারলে ঠিকসে মাইর দিবো।
আরো সময় গড়ালো। ক্লাস টেনে উঠলাম। সে সময় পাগলের মত বাপের সাথে বসে বসে রেসলিং দেখতাম। ফেভারেট রেসলার হলো রক। অনেক চেষ্টা চরিত করে ব্যাটার মত এক ভ্রু উচা করাও শিখে ফেললাম। এই রেসলিং জিনিসটা এতটাই পছন্দ করতাম যে, চার বছরের ছোট কাজিন অনিকের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে সিদ্ধান্ত নিলাম যে রেসলার হবো। সেজন্য ব্যায়াম করাও শুরু করলাম। ব্যায়াম করি আর অনিক আমাকে পাশ থেকে উতসাহ দেয়, ‘ওহ! ভাইয়া দারুণ হচ্ছে। তোমার বাইসেপসগুলো পুরাই রক টাইপ হচ্ছে’। আমার খুশি আর দেখে কে? আরো উতসাহের সাথে ব্যায়াম করতে থাকি। অবশ্য এখন আমার ভুড়ি দেখে এই কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। বলবে, ‘বেটা, তোমার হওয়া উচিত আছিলো বিবিসি (BBC)। বিশ্ব বিখ্যাত চাপাবাজ (Bissho Bikkhato Chapabaz)।’
এক সময় আরো বড় হলাম। কলেজে ভর্তি হলাম। লেখাপড়ার যাতাকলে পড়ে আমার জীবনের লক্ষ্যগুলো সব হারিয়ে গেলো। আমার আশেপাশের সব এক্সট্রা-অর্ডিনারী ব্রিলিয়ান্ট ছেলেগুলোর ভবিষ্যত পরিকল্পনা আর জীবনের লক্ষ্যগুলোর মধ্যে থেকে নিজের জীবনের লক্ষ্য খুজে পেতে চাইলাম। এটাই ভরসা ছিলো যে, যাইহোক না কেন অন্তত আমার জীবনের লক্ষ্যগুলোর চেয়ে তাদেরটা ভালো হবে। মনস্থির করলাম যে, ট্রিপল-ই তে পড়বো, ইঞ্জিনিয়ার হবো। যদিও তখনও জানতাম না যে, সাবজেক্টটা কেমন, সহজ না কঠিন, পারবো নাকি পারবোনা। কিন্তু বিধিবাম। এইচ.এস.সির ভালো রেজাল্টের গরমীতে ট্রিপল-ইতে চান্স পেলাম না। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেলাম। তবে অ্যাপ্লাইড ফিজিক্সে। এ সাবজেক্ট চয়েজ লিস্টে এক নম্বরে রাখার কারণ ছিলো সাবজেক্টের নামের সাথে ইলেকট্রনিক্স থাকায় নামটা বেশ মনে ধরেছিলো। আর কোন কারণ নাই।
অনার্স পড়তে পড়তেই আমি আবিষ্কার করলাম যে, ইতিহাসের প্রতি আমার বিশেষ প্রীতি। নিজের সার্কিট অ্যানালাইসিস বই বাদ দিয়ে কাজিনের ইতিহাসের বই পড়তে বেশ মজা লাগে। একদিন আম্মাকে মিনমিন করে বললাম যে, ‘আম্মা আমার ইতিহাস পড়তে ভালো লাগে। আমি সাবজেক্ট চেঞ্জ করলে কি কোন সমস্যা আছে?’ এই কথা শোনার পর আম্মা যে হুঙ্কার ছাড়লো তা মনে করলে এখনও ছোটখাটো হার্ট-অ্যাটাকের মত অবস্থা হয়।
একজন প্রিয় ফোরামিক আমার সম্পর্কে বলেছিলেন যে, ‘প্রযুক্তির এই মানুষটার সাহিত্যপ্রীতি দেখে খুবই অবাক হই’। ধুর মিয়া, প্রযুক্তির মানুষতো ফাপড়ে পইরা হইছি। যা পড়তে ইচ্ছা করে সেইটা পড়ে ভালো ভবিষ্যত গড়ার নিশ্চয়তা থাকলে আমার আম্মা হুঙ্কারও ছাড়তো না, দেশও একজন ইতিহাসবিদ হারাতো না। মনে খালি আফসোস আর আফসোস। কিন্তু কি আর করার? কিছুই করার নাই। তবে আমার ছোটবেলার জীবনের লক্ষ্যগুলোর মধ্যে একটা আংশিক পূরণ হয়েছে। প্রাইমারী স্কুলের এইচ.এস.সি পাশ টিচার হয়ে মাসুম পোলাপানরে বেতাইতে পারার লক্ষ্য পূরণ না হলেও, শিক্ষক হওয়ার লক্ষ্য পূরণ হয়েছে।