প্রায় এক যুগ কারাবাসের পর অবশেষে নিউইয়র্ক-সিটি-জেল (জেল/ শহর/ বস্তি/ চিরিয়াখানা… যে নামেই ডাকেন!) থেকে মুক্তি পেলাম। এ যুগের সমাজ ব্যাবস্থা এতোটাই আঠালো যে একটা জীবন ধারায় জড়িয়ে গেলে সেখান থেকে বেরিয়ে আসা প্রায় অসম্ভব। সমাজ কলের চাকা হিসেবে জীবন বিলিয়ে দেয়ার বিরুদ্ধে প্রবল মনোবল, সেই সাথে একটু আধটু লাক মিলিয়ে ইচ্ছেটা শেষ পর্যন্ত পুরন হয়েই গেল।
স্পেক্টেটরদের মুখবন্ধ করার জন্য “মোটা-মাইনের মুলো”র যোগার থেকে শুরু করে, পুর্ব পুরুষ প্রদত্ত স্থানান্তরে-অনিহা-জিনের দরুন পেট-প্রজাপতির মোচড় কে উপেক্ষা করা পর্যন্ত, বহু ঝক্কির মোকাবেলা করতে হয়েছে। মাস খানেক পর মূল্যায়ন হল, সমস্ত ঝক্কিকে একপাল্লায় এবং প্রাপ্ত/প্রত্যাশিত প্রশান্তিকে অন্য পাল্লা মেপে এক কথায় ফল প্রকাশ হল, "সার্থক"!
নিউইয়র্ক সিটি ছাড়ার মুল কারন ছিল তিনটা। কারন গুলো হল পিপল, পিপল, এবং পিপল। ব্যাখ্যা করি..
#১ ঘনবসতি:
দুনিয়ার প্রায় সর্বোচ্চ ঘনবসতি পূর্ন এলাকা থেকে পৃথিবীর অপর প্রান্তে এসে আরেক ঘনবসতি এলাকায় এসে পরেছিলাম। এ যেন ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে পড়ার মত! ভাবছেন ঘন বসতিতে সমস্যা কি? ফোরামিক সারিম এর স্টেটাস লাইনটা পড়ে দেখুন! এ ছাড়াও ঘনবসতির পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হল জায়গার অপ্রতুলতা এবং পরিশেষে ডিমান্ড সাপ্লাই কার্ভ অনুসারে দুর্মুল্য, বিশাল জনসাধারনকে বশে রাখার জন্য অদ্ভুত সব আইন জারি, জীবনের অর্ধেক ফ্রী সময় জ্যামে আর লাইনে বসে কাটানো, ইত্যাদি ইত্যাদি।
#২ রুডন্যাস
দুই নাম্বার কারন হল, অভদ্র লোকজন এড়ানো, প্রথম কারনের সাথে একে গুলায়া ফেলার কারন নেই। রুডন্যাস বা চেটাং-মেজাজ সাধারনত উদ্ভব হয় হাই স্ট্রেস এনভারমেন্ট থেকে। আমি নিশ্চৎ রুডন্যাসের দেশ ব্যাপি জরিপ করা হলে নিউইয়র্ক সিটি #১ হবে। ট্রাফিক লাইটে গাড়ি দাড় করিয়েছেন, লাইট লাল থেকে সবুজ হবার আধা সেকেন্ডের মধ্যে পেছন থেকে চল্লিশ জন হর্ন দেবে। তারাহুড়া জনিত রুডন্যাস সর্বত্র। আরেক ধরনের রুডন্যাস আসে ম্যাস প্রডাকশনের অযোগ্য রিসোর্সের অপ্রতুলতার জন্য। যেমন পার্কিং স্পেস, আপনি এক যায়গায় পার্ক করতে যাচ্ছেন আপনাকে ডিঙিয়ে অন্য দুজন সামনে এবং পেছন থেকে গাড়ি ঢুকিয়ে ঝগড়া শুরু করে দেবে। আর মানব জাতীর স্বভাবগত প্রিডিটরী বৈশিষ্টতো আছেই। (এই উদাহরটাও গাড়ি দিয়েই দিই) আমার এর পরশীর কার্যক্রম বলি, একদিন গাড়ি নিয়ে আমার ব্লকে ঢুকলাম দেখি কোন খালি পার্কি স্পট নেই (স্বাভাবিক ব্যাপার)। অন্যদিকে যাব… তখনই দেখি সামনের একজন বেরুচ্ছে। আমি তার যায়গায় পার্ক করব ভেবে পার্ক সিগনাল অন করে খানিকটা পেছনে দাড়ালাম। ও কি করল বলি, গাড়ি বের করে সামনের গাড়ির সাথে প্যারালালে দাড়ালো, গাড়ি থেকে বেরিয়ে সামনের গাড়িতে উঠল, গাড়ি স্টাট দিয়ে বেক করে দুই পার্কিং এর মাঝামাঝি যায়গায় গাড়িটা রাখল, তার পর বেরিয়ে বাইরের গাড়িতে উঠে চলে গেল। আমি তাজ্জব হয়ে বসে রইলাম!
#৩ ইমিগ্রেন্ট এবং টুরিস্ট মেজরিটি:
নীড় বিহীন মানুষের সমস্যা হল এরা কোন কিছুকে তোয়াক্কা করেনা। কাউকে যদি বলেন উলঙ্গ হয়ে রাস্তায় এক মিনিট দৌড়ানোর জন্য একশ টাকা দেবেন, হেসে উরিয়ে দেবে। কিন্তু আপনি যদি গেরান্টি দিতে পারে যে তার উলঙ্গ হয়ে রাস্তায় দৌড়ানোর ঘটনাটা তার পরিচিত অথবা তাকে অতিত/বর্তমান/ভবিস্বতে চিনতে পারে এমন কেউ দেখতে বা জানতে পারবেনা, তাহলে অফারটা অনেকেই ভেবে দেখবে। ভাবটা এমন এখানে আসলাম গতকাল, আগামীকাল হয়তো অন্যযায়গায় চলে যাব, আজকে এখানে কি করছি না করছি তাতে কি আসে যায়! ফল স্বরুপ বাসে উঠে অন্যের পা মাড়িয়ে নির্বিকার থাকা, বা কারো বেকইয়ার্ডে ঢুকে কুমড়া চুরি করার মত কাজ করতে বিবেকে বাধে না!
প্রথম তিন কারনের বাইরে আরেকটা ছোট (?) কারন হল আবহাওয়া! কোথায় যেন পড়েছিলাম কি এক ব্যাকটেরিয়ার কথা যাকে ফুটন্ত পানিতে মারা যায়না। একে মারার উপায় হল প্রথমে ফ্রোজেন করা পরে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে বয়েল করা। হ্যাভি হিটার আর এসি ইকুইপ্ট নিউইয়র্ক বাসীদের নিয়ে বিধাতা ঐ খেলাই খেলে। শীতে টেম্পারেচার নামবে শুন্যের নিচে, কয়েক সপ্তাহ পর সেটা গিয়ে উঠবে নব্বুইএর উপরে!
লেখাটা সত্যিকার অর্থেই বটগাছের কাছে। অথবা "ভবিস্বতের আমি”র আছে এই অতীতের আমি থেকে। আজ থেকে আরো দু/এক যুগ পর সুখি অথবা দুখি আমি(?) যখন জীবনের এই অধ্যায়ের পর্যালোচনা করব, এই লেখাটা হবে প্রথম পাতা। ভবিস্বতের সেই লোকটা যদি সুখি হয় তাহলে আর বেশী কিছু বলার নেই শুধু এইটুকু যে শ্রমটা দিয়েছিলাম এই অতিত-আমি। আর সে যদি দুখি হয় (দুখি হবার সম্ভবনাই বেশী। মানব মস্তিস্কের দুখি-র দিকে এ্যাসিমটোপের ম্যাথ প্রুফ আরেকদিন দেব!) তাহলে এটুকু বলতে চাই এর জন্য দায়ী অতিত-আমি নই! কারন এটাকে এড়ানো সম্ভব ছিলনা। সময়-চাকার এই বিন্দুতে, সম্ভ্যাব্য সকল ভবিষৎ পরিনতি এবং দৈবঘটনা (আউটকামস্ এন্ড কনটিন্জেন্সিজ) যাচাই এবং হিসবে করেই এই সিদ্ধান্তে রায় দিয়েছি। দু/এক যুগ পর যদি এটা মনে যে নিউইয়র্কে "থেকে গেলেই ভাল হত" সেটা মনে হওয়ার সম্ভ্যাব্য কারন হল, নিউরন একটা দুর্বল স্মৃতি ধারন মাধ্যম, অপর পাল্লার অনেক উৎপাদক ততদিনে হয়তো ভুলে গেছি! বহু বছর আগের নিউরন-জালের অধিকারী হবার দরুন সঠিক সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা শুধু অতিতের আমিই রাখি! অতিত ভবিস্বতের চেয়ে বেশী স্টেবল, ভবিস্বতের "থেকে গেলেই ভাল হত" জাতীয় ধারনাকে অতিত ক্ষমতা বলে এখনই খারজি করে দিলাম!
ভাল খারাপ মামলা নিস্পত্তির পর এবার মনোযোগ দেই আসল কাজে। “আমেরিকান ড্রিম...”, পারিপার্শিক অবস্থা আর আর্থিক সীমা বোঝার পর শহরের মোহ কাটতে বেশী সময় লাগেনি, সেই থেকে স্বপ্ন হল নাশীতাউষ্ণ অঞ্চলের কান্ট্রিসাইডে স্থানান্তরিত হওয়া, এরপর আম-কাঠালের বাগ এবং তাল-পুকুড় সহ ভুতুরে-বড় বাড়ি বানানো। সাথে একটা বিশাল ওয়ার্কশপ যেখানে বানাবো কাঠের পিড়ি হতে শুরু করে স্পেসশীপ পর্যন্ত! স্থানন্তরের সাথে সাথে প্রথম ধাপ পূর্ন। দ্বিতীয় ধাপের কার্যসূচী চলছে আশাব্যঞ্জক গতিতে। দেখা যাক কি হয়।