Quantcast
Viewing all articles
Browse latest Browse all 15150

গোলকের ব্যাস আট ইঞ্চি, পর্ব-৫

পূর্বেঃ গোলকের ব্যাস আট ইঞ্চি, পর্ব-৪

     মাঠের মধ্যে গোল হয়ে বসে মাহাদী আর কিশোর ছেলেগুলোর দলটি। মাহাদী গুণে দেখে যে ওরা মোট তেরো জন। গ্যালারী থেকে সামরিনা আর হাসানও এসে যোগ দেয় ওদের সাথে। মাহাদীই প্রথমে কথা বলা শুরু করে,
-    আমি যে প্রস্তাব দিলাম সেটার ব্যাপারে তোমাদের সবার মতামত কি?
লিকলিকে শরীরের একটা ছেলে সবার আগে বলে ওঠে,
-    স্যার, বাফুফু না কি জানি কইলেন, হেইডা কি জিনিস তাইতো জানিনা।
পাশ থেকে পরিপাটি করে আচড়ানো চুলের আরেকটা ছেলে জবাব দেয়,
-    আবে জাহিইদদ্যা, বাফুফে কি জিনিচ জানছ না কেল্লা? এইডা হইলো আমাগো দেসের ফুটবলের মা-বাপ। ঠিক কইছি না স্যার?
-    হ্যা। ঠিক বলেছো। তোমার নাম কি ছেলে?
-    ভালা নাম রুস্তম আলী। আব্বায় সোহাগ কইরা ডাকে রাজু বইলা।
-    ওকে। রাজু। তুমি বেশ ভালোই জানো দেখছি ফুটবল সম্পর্কে।
-    জানুম না কেল্লা? আব্বার লগে নিয়মিত স্টেডিয়ামে যাই খেলা দেখবার। যেই বলটা দেখতাছেন , এইটাও আব্বায় কিনা দিছে।
-    ভেরী নাইস। তোমার আব্বা দেখা যায় ফুটবল খুব পছন্দ করেন।
-    আবার কয়! আব্বা কইচে, ফুটবল হইলো মর্দগো খেলা। আর বাকি সব হইলো আওরাতগো খেলা।
-    হা হা হা। তুমি কি স্কুলে পড়ো?
-    হ, পড়ি ভি, আবার আব্বার সাথে দোকানে কাম ভি করি।
-    হম্ম। দোকান কোথায়?
-    কাপ্তান বাজার। মুরগীর ব্যবসা।
-    তোমার আব্বা তোমাকে এখানে খেলতে দিবে?
-    আজব কথা! দিবো না কেল্লা?
পুরান ঢাকার এই ছেলেটা না হয় খেলবে, কিন্তু বাকিরা? একটু চিন্তিত হয়ে বাকিদের দিকে তাকায় মাহাদী। তারপর রাজুকে বলে ওঠে,
-    তুমি না হয় খেললা। কিন্তু বাকিরা?
রাজু এবার লিড নিয়ে হাত তুলে কয়েকজনকে দেখিয়ে বলে ওঠে,
-    স্যার, বামে থেইকা দেখতাছেন বইসা আছে রনি, সাহীন, সোহাগ, সুভো, সানি আর স্যামল। এরা খেলবো। সমস্যা নাইক্কা। বাকিদের কথা আমি জানিনা স্যার।
এবারে মাহাদী ডানদিকে বসে থাকা চার-পাচ জনকে নির্দেশ করে জিজ্ঞেস করে,
-    নাম কি তোমাদের? তোমরা কি কর? খেলতে পারবা?
শীর্নকায় একটা ছেলে সবার হয়ে উত্তর দেয়ার দায়িত্ব তুলে নেয়।
-    স্যার, মোর নাম ইদ্রিস। বাড়ি বরিহাল। হ্যাগো নাম হইলো কামাইল্যা, জামাইল্যা, রিপন, পিনু। আমরা স্যার থাহি সোরাওয়ার্দীতে। কামাইল্যা আর জামাইল্যা কাগজ টোকায়। রিপন আর পিনু কাম করে ফুলের দোহানে। আর মুই হকার। প্যাপার বেচি শাহাবাগ সিগন্যালে।
-    থ্যাঙ্কু ইদ্রিস। সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্যে। কিন্তু কথা হচ্ছে যে, তোমরা কি খেলতে পারবা?
-    স্যার, খেলাতো কোন বিষয় না। কিন্তু আমাগো কামও করা লাগবো। খেইলাতো আর পেড চলবো না।
এবারে খুব চিন্তিত দেখায় মাহাদীকে। উদ্ধারে এগিয়ে আসে হাসান।
-    আমরা জানি যে, তোমাদের অনেকরই কাজ করা লাগে। এজন্যে আমি চেষ্টা চালাচ্ছি যাতে কিছু করা যায়। যেদিন যেদিন তোমাদের স্যার তোমাদের প্র্যাকটিস করাবেন, সেদিন করে প্র্যাকটিসের পরে পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা হবে। আর তোমাদের মাসিক কোন ভাতার ব্যবস্থা করা যায় কিনা সেটাও আমি দেখবো।
কিশোর ছেলেগুলোর মুখ এবার একটু উজ্জ্বল দেখায়। মাহাদী এবারে আরও কিছু যোগ করে,
-    সাকিব-তামিমরা যখন ক্রিকেট খেলা, তখন সারা দেশের মানুষ ওদের জন্যে দোয়া করে। কারণ ওরা দেশের জন্যে খেলে। ওরা জিতলে পাগলের মতন আনন্দ মিছিল বের করে। হারলে চোখের পানি ফেলে। তোমরাও বিদেশী একটা দলের বিরুদ্ধের খেলবা একদিন। হয়তো এটা জাতীয় দল না। কিন্তু দলতো? বিদেশ থেকে আসা দলের বিরুদ্ধে খেলা মানে একরকম দেশের জন্যেই খেলা। হয়তো অনেক দর্শক থাকবে না। অল্প কিছু দর্শক থাকবে। তোমরা ভালো খেললে তারাই আনন্দ করবে। তোমাদের জন্যে দোয়া করবে। আর হারলে...... প্র্যাকটিসই শুরু করতে পারলাম না, তার আগেই হারের চিন্তা করা তাই ঠিক না। আমরা খেলবো এবং জেতার জন্যেই খেলবো।

সব ছেলেগুলোর চোখেমুখে ঠিকরে ওঠে দৃঢ় সংকল্প। ইন্সপায়ার্ড ছেলেদের দল থেকেই বড় বড় চোখের কামাইল্যা জিজ্ঞেস করে,
-    স্যার, একটা কথা জিগাইতাম?
-    বলো?
-    ডর লাগে স্যার। আপনে গোস্বা করবেন।
ছেলেটার কথা শুনে হেসে ফেলে মাহাদী। তারপর বলে ওঠে,
-    নাহ কামাল। আমি গোস্বা করবো না। জিজ্ঞেস করো।
-    স্যার, আমাগো খেলা শিখাইলে আপনেরে বাফুফে অনেক ট্যাকা দিবো, না?
প্রশ্নটা শুনে একটু থমকে যায় মাহাদী। তারপর আবার হেসে জবাব দেয়,
-    নাহ, কামাল। বাফুফে মনেহয় না আমাকে কোন টাকা দিবে।
এবারে কামালের হতবাক হওয়ার পালা। সে একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
-    তাইলে আপনে আমাগো খেলা শিখাইবেন কেন? আপনেতো ওস্তাদ কালাচানের মতন ভালা খেলেন। হ্যায়ও তো ট্যাকা নেয়।
মাহাদী পাশে পড়ে থাকা রাজুর ফুটবলটা হাতে উঠিয়ে নেয়। তারপর জবাব দেয়,
-    মানুষের হৃদয় বা হার্ট বা দিল কোথায় থাকে জানো তোমরা?
সব ছেলেরা প্রায় একসাথে বুকের বাম দিকে দেখিয়ে জবাব দেয়,
-    বুকের এইখানে।
মাহাদী হাতের ফুটবলটাকে দেখিয়ে বলে,
-    হ্যা, হবে হয়তো। কিন্তু আমার হৃদয় আছে  এই আট ইঞ্চি ব্যাসের গোলকটায়, যেটাকে তোমরা ফুটবল নামে চেনো। এটা ছাড়া হয়তো আমি থাকবো। কিন্তু মরা লাশের মতন। তাই বেচে থাকার জন্যে তোমাদের শিখাবো। বিনে পয়সায় শিখাবো।
কিশোর ছেলেদের দলটা অবাক বিস্ময়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে দেখতে থাকে। গুলিস্তান আন্ডারপাসের পাগলটাকেও তাদের কাছে মাহাদীর চাইতে সুস্থ মনে হয়।

ছেলেদের সুবিধা-অসুবিধার কথা আলাপ আলোচনা করে মাহাদী পরেরদিন ভোর ছয়টায় প্র্যাকটিদের সময় ঠিক করে। তারপর মিটিং ভেংগে দেয়। হাসানও বিদায় নিয়ে চলে যায়। সন্ধ্যা হয়ে গেছে প্রায়। সামরিনা মিরপুরেই থাকে। কাজেই মাহাদী বাসায় ফেরার পথা ওর সাথী হয়। সমস্ত মিটিং জুড়ে চুপ করে থাকা সামরিনা গাড়িতে উঠে প্রথমবারের মতন মুখ খোলে।
-    তাহলে আপনার হৃদয় আট ইঞ্চির গোলকে?
-    আসলে হৃদয় বলেছি রূপক অর্থে।
-    সেটা আমি জানি। তাও ভালো। আমিতো আগে ভাবতাম আপনার হৃদয়ই নাই।
মাহাদী চুপ করে সামরিনার খোচাটা হজম করে। তারপর আস্তে আস্তে বলে ওঠে,
-    আসলে আমার স্বপ্নগুলো খুব উদ্ভট ধরনের। এজন্যে কাউকে বলি না। সবাই বিরক্ত হয়। পাগল ভাবে।
-    আমি সবার মতন না। একবার আমাকে বলে দেখতেন। আর একটা কথা, আপনার স্বপগুলো মোটেই উদ্ভট না। যারা ওরকম ভাবে, তারাই পাগল।
সামরিনার কথা শুনে মাহাদীর চোখগুলো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। গাড়ির জানালা আসা রাস্তার সোডিয়াম লাইটের আলো মাহাদীর মুখে এসে পড়ছে। ওর স্বপ্নাতুর চেহারাটার দিকে তাকিয়ে থাকে সামরিনা। মাহাদীর স্বপ্নপথের চলার সঙ্গী হতে ইচ্ছে করে ওর। মাহাদী বুঝতে পারে যে সামরিনা ওকে দেখছে। সামরিনার চুলগুলো বাতাসের উড়ে এসে মাঝে মাঝে ওর মুখে লাগছে। মাহাদীর ইচ্ছে করে সামরিনার মাথাটা ওর কাধে রেখে এক হাত দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে। নিজেকে সংবরণ করে মাহাদী। কিছু কিছু জিনিসের প্রাপ্তির আকাঙ্খা অনেক মধুর। গাড়ি চলছে। ড্রাইভার হালকা সাউন্ডে গান ছেড়ে দিয়েছে। “এলোমেলো মন ভাবে শুধু তোমায় আজ, শেষ হবে রাত, শুধু তুমি আমি আজ”। গানের কথাগুলো ওদের মনের অবস্থার সাথে মিলে যায় অনেকখানি। কাকতালীয়? হবে হয়তো।
[চলবে]


Viewing all articles
Browse latest Browse all 15150

Trending Articles



<script src="https://jsc.adskeeper.com/r/s/rssing.com.1596347.js" async> </script>