(পূর্বকথা...
বাইরে দেখি আমার মোটর সাইকেলটা দাঁড়িয়ে আছে। বাইরের ঘরে কমল ঘুমাচ্ছে। তাকে ডেকে তুললাম। আমি পুরোপুরি ভাল আছি দেখে সে কিছুটা অবাক হলেও খুশিই হয়ে উঠল। উঠে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে এসে বলল যে মোটর সাইকেলের বেশী কিছু হয়নি, আবার চালানো যাবে। আমরা আর দেরী না করে রওনা দিয়ে দিলাম। এবার আর সাঁকোর কাছে না গিয়ে ঘুর পথে গিয়ে শেষ পর্যন্ত রতনগড়ে ফেরত গেলাম।...)
ফিরে আসার পর কমল আর দেরী করেনি। ওইদিনই দুপুরের ট্রেন ধরে সে ফেরত চলে যায়। এরপরে এসব ব্যাপারে তার সাথে আর বিস্তারিত কোন আলাপ আর করার সুযোগ হয়নি। বহুদিন তার সাথে যোগাযোগও অবশ্য ছিলনা। মাস দুয়েক আগে আমি একটা বিশেষ কাজে ঢাকায় আসি। হঠাৎই নিউমার্কেটে কমলের সাথে দেখা। আমাকে দেখে কিছুতেই ছাড়তে চাইলনা। জোর করে তার মেসে নিয়ে গেল। দুপুরে খাওয়াল। তারপরে অনেকক্ষন আড্ডা দিলাম। চৈতন মিয়ার কথা অবশ্য আমাদের কারোরই মনে আসেনি তখন। যাহোক, বিকেলের দিকে আমি বেরোব, কমলও বলল সে একটু বাইরে যাবে, একসাথে বেরোনো যাবে। আমি তখন একটু বসলাম আর সে রেডি হয়ে আসতে গেল। তার টেবিলের ওপর বইগুলো দেখছি, হঠাৎই আমার চোখ পড়ল একটা ছোট মূর্তির উপর, সাদা রঙের। এমন মূর্তি কোথায় যেন দেখেছি মনে হতেই মনে পড়ল ঠিক অবিকল মূর্তি আমি চৈতন মিয়ার বাক্সটাতে দেখেছিলাম। কিন্তু এটার মুখটা যেন ঠিক কমলের মত দেখতে। যদিও অতটা স্পষ্ট পটু হাতের কাজ নয়, বরং কিছুটা এবড়োথেবড়োই বটে। কিন্তু ঠিক কমলের মতনই চাপা গাল আর বড় কপাল, ভুল হবার কোন উপায়ই নেই। আমি অবাক হয়ে মূর্তিটা হাতে নিয়ে দেখছি, এমন সময় কমল রেডি হয়ে আসতেই আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম
- এই মূর্তি তুই কোথায় পেয়েছিস?
- ওহ্ এইটা? নীলার কথা তোকে বললাম না? এটা ওর তরফ থেকে সারপ্রাইজ গিফট।
- এটা নীলা তোকে দিয়েছে?
- হ্যাঁ! ওইদিন সন্ধ্যায় মেসে ফিরে দেখি পাঞ্জাবীর পকেটে এটা। সারা বিকেল দুজনে একসাথে ঘুরেছি। এক ফাঁকে নিশ্চয়ই সারপ্রাইজ দেবার জন্য পকেটে ঢুকিয়ে দিয়েছে। আমিও পরে আর ওকে মূর্তিটার কথা বলিনি, ভাবটা এমন যে আমি দেখিইনি। নিজে থেকে বলুক, তারপর আমিই ওকে সারপ্রাইজ করে দেব ভেবেছিলাম। কিন্তু মনে হয় সেও ভুলেই গেছে। মূর্তিটা বেশ অদ্ভুত না? আমার চেহারার সাথে বেশ মিলে। কোত্থেকে জোগাড় করেছে কে জানে? তুই বলায় ভালই হল, জিজ্ঞেস করব কোথায় পেয়েছে?
আমি তার কথা শুনতে শুনতে কিছুটা মনে হয় অন্যমনস্কই হয়ে পরি। খানিকটা অবাকও হয়েছিলাম, একই রকম দেখতে হলেও এটা চৈতন মিয়ার মূর্তি কিভাবে হয়? কমল তো আর কখনো তার কাছে যায়ইনি। যাইহোক, এরপর ঐদিন রাতেই আমি রতনগড় ফিরে যাই।
এর দুই দিন পর আমাদের আরেক ক্লাসমেট, সাদেক আমাকে মোবাইলে কল দিয়ে জানায় কমল নাকি এক্সিডেন্ট করেছে। একটা নির্মানাধীন বাড়ির পাশে হাঁটছিল, হঠাৎ উপর থেকে একটা রড পড়ে তার ডান কাঁধের ভেতর দিয়ে ঢুকে পেট দিয়ে বেরিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গেই তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তিন ঘন্টা ডাক্তারদের চেষ্টা চরিত্রের পর সে রাত নয়টার দিকে মারা যায়।
এ পর্যন্ত এসে ইমরান একটু থামল। বেশ ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে তাকে।
- স্যার, একটু পানি খাব।
মিসির আলী নিজেই পানি আনতে উঠে গেলেন। পানি এনে ছেলেটার হাতে দিতেই ঢক ঢক করে পুরোটা শেষ করে টেবিলে গ্লাসটা রাখল। মিসির আলী বসতে বসতে বললেন
- তোমার মূর্তিটা কি সঙ্গে এনেছ?
- স্যার?
ছেলেটা একটু বোকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল।
- দেখ, তুমি গল্প শুরুর প্রথমেই বলেছ এটার উপর তোমার জীবন নির্ভর করছে। কাজেই আমি নিশ্চিত যে ঠিক একই রকম একটা মূর্তি তুমিও পেয়েছ, যার চেহারার আদল তোমার সাথে মেলে। আর আমার যদি ভুল না হয়, মূর্তিটা তুমি তোমার ডান পকেটে করে নিয়ে এসেছ।
ছেলেটা কোন কথা না বলে মূর্তিটা বের করে টেবিলে রাখল। মিসির আলী মূর্তিটা হাতে নিলেন। আড়াই থেকে তিন ইঞ্চি লম্বা হবে, আর আসলেই বেশ ভারী। চট্ করে যে কেউ মনে করবে কোন ধরনের নরম, স্বচ্ছ পাথরে তৈরী। শরীরের অবয়ব স্পষ্ট নয়, একটু সিলিন্ডারের মত। হাত দুটোর উপস্থিতি বুঝা যায়। চেহারা দেখে মনে হয় আনাড়ি কেউ টিপে টিপে বানিয়েছে। এরপরেও ইমরানের মুখের সাথে যথেষ্ট মিল। চাপা নাক, বড় থুতনি স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
চলবে...