(পূর্বকথা...
ছেলেটা কোন কথা না বলে মূর্তিটা বের করে টেবিলে রাখল। মিসির আলী মূর্তিটা হাতে নিলেন। আড়াই থেকে তিন ইঞ্চি লম্বা হবে, আর আসলেই বেশ ভারী। চট্ করে যে কেউ মনে করবে কোন ধরনের নরম, স্বচ্ছ পাথরে তৈরী। শরীরের অবয়ব স্পষ্ট নয়, একটু সিলিন্ডারের মত। হাত দুটোর উপস্থিতি বুঝা যায়। চেহারা দেখে মনে হয় আনাড়ি কেউ টিপে টিপে বানিয়েছে। এরপরেও ইমরানের মুখের সাথে যথেষ্ট মিল। চাপা নাক, বড় থুতনি স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।)
- কবে পেয়েছ এটা?
- এটা স্যার গত পরশুদিন পেয়েছি। বাজার করে বাসায় ফিরে এসেছি। খুচরা টাকা টেবিলের ড্রয়ার খুলে রাখতে যাব, এমন সময় দেখি একপাশে এটা পরে আছে। তুলে নিয়ে দেখি ঠিক কমলের মূর্তিটার মতই গড়ন, তবে আমার চেহারার আদলের। প্রচন্ড ঘাবড়ে যাই। কাল পর্যন্ত বুঝে উঠতেই পারিনি কি করব? হঠাৎ আপনার কথা মনে হল। স্যার, আমি বিশ্বাস করি আমাকে যদি কেউ বাঁচাতে পারে, তো আপনিই পারবেন।
- আমি আগেই বলেছি তোমাকে, এসব বিষয়ে আমার অনুভূতি ভোঁতা হয়ে গেছে। আগের মত আর চিন্তা করতেও পারিনা। মনে হয়না আমি তোমার তেমন কোন উপকারে আসব।
- তবু স্যার, আপনার কি মনে হয় এটুকু শুধু বলে দেন। হয়তো আসলেই আমার মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে, তবু শেষ চেষ্টাটুকু করতে দোষ কি।
- হুঁ।
মিসির আলী খানিকক্ষণ চুপ করে থাকলেন।
- তোমার খালাত ভাই যখন মারা যায় তখন তার বয়স কত ছিল?
- স্যর, দশ-এগারো বছর হবে।
- তার খেলনার বাক্স, বা তার জিনিসপত্র কি কখনো তুমি দেখেছ?
- না তো, স্যার। কেন?
- আমার ধারণা ওখানে খুঁজলে তোমার খালাতো ভাইয়ের চেহারারও একটা মূর্তি পাওয়া যাবে।
- কিন্তু স্যার, ওতো সাপের কামড়ে মারা গিয়েছে।
- হতে পারে, কিন্তু এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা না হবার সম্ভাবনাই বেশী। চৈতন মিয়া নিজেই তোমাকে বলেছে আজরাইল ফেরত যেতে পছন্দ করেনা। আমার মনে হয় সে বুঝিয়েছে যে ভিন্ন বেশেও মৃত্যু ফেরত আসতে পারে। কাজেই যত জনাকে সে সারিয়ে তুলেছে, আমার ধারণা কোন না কোন ভাবে তারা পরবর্তীতে ঠিকই কোন দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছে। এটা নিজে জানত বলেই সম্ভবত সে চিকিৎসার বিনিময়ে কারো কাছ থেকে টাকা-পয়সা নিতনা।
ছেলেটা বেশ খানিকক্ষণ নির্বাক হয়ে থাকল।
- কিন্তু স্যার এটা কিভাবে সম্ভব।
- দেখ, সাইকিক ক্ষমতা যাদের আছে তাদের নিয়ে বেশীরভাগ গবেষণাই আজ পর্যন্ত অমীমাংসীত রয়ে গেছে। আমার যেটা মনে হচ্ছে, তোমার এই চৈতন মিয়াও কোনভাবে এমন একজন সাইকিক মিডিয়াম। এদের মাঝে টেলিপোর্ট বলে একটা বিশেষ ক্ষমতা আছে বলে জানা যায়, যার মাধ্যমে এরা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় কোন বস্তু পাঠিয়ে দিতে পারে, কোন ফিজিক্যাল মাধ্যম ছাড়াই। এই ক্ষমতা চৈতন মিয়ার থাকা বিচিত্র কোন কিছু নয়। এখন আসা যাক তেলটার ব্যাপারে। ইভা ক্যারীয়ের নামে ফ্রান্সের একজন সাইকিক মিডিয়াম ছিল যিনি মানুষের সামনে দুই হাতের মাঝে শূন্য থেকে এনার্জী ফিল্ড তৈরী করার খেলা দেখাতেন। উনার এই সাইকো-কাইনেটিক ক্ষমতা নিয়ে আর্থার কোনান ডয়েল, হ্যারী হুডিনির মত মানুষেরাও গবেষণা করেছিলেন। কিন্তু কোন নির্দিষ্ট মীমাংসায় আসতে পারেননি। ইভা যখন এই খেলা দেখাতেন তখন তাঁকে দেখে মনে হত কোন ট্রান্স স্টেট জগতে আছেন। আর এ সময় তার কান, নাক থেকে একটা জেলীর মত সাদা পদার্থ বেরিয়ে আসত। তিনি এর নাম দিয়েছিলেন এক্টোপ্লাজম। বিজ্ঞানীরা এটা নিয়ে গবেষণা করেও বের করতে পারনি জিনিসটা কি। তারা শুধু এটাকে আন-আইডেন্টিফায়েড ফ্লুইড বা সাইকিক ম্যাটেরিয়াল নাম দিয়ে রেখে দিয়েছে। তুমি চৈতন মিয়ার চোখ থেকে যা বের হতে দেখেছ মনে হয় তা তেমনই কিছু হবে। এই মূর্তিটা যদি ওটা দিয়েই তৈরী হয় তবে এটা গবেষকদের কাছে প্রচুর মূল্যবান হবে বলেই আমার ধারণা।
- কিন্তু স্যার এটা দিয়ে রোগীর চেহারার আদল করার কারনটা কি।
- বলছি, তবে তার আগে বলে নেই যে চৈতন মিয়া তার চিকিৎসা পদ্ধতি কাউকে দেখাতে চাইত না কারন সে ট্রান্স স্টেট অবস্থায় অবচেতন মনে মূর্তি তৈরী করত নিজেরই সাইকিক ফ্লুইড দিয়ে, যা দেখলে বেশীর ভাগ মানুষেরই ভয় পাবার সম্ভাবনা। উপরন্তু পরে যখন ব্যাক্তি মূর্তিটি পাবে, কোন ভাবে তার বুঝে যাবারও সম্ভাবনা আছে যে এর সাথে চৈতন মিয়াই নিশ্চিত ভাবে সম্পর্কিত। তাই ভাং খাইয়ে তাদরকে ঘুম পাড়িয়ে চিকিৎসা করাই তার জন্য নিরাপদ ছিল। মূর্তি তৈরীর ক্ষেত্রে তার দুটো কারন থাকতে পারে। এক, রোগীর চেহারা চিহ্নিত করে রাখা। দুই, কেউ নিজের চেহারার মূর্তি দেখলে সহজে নষ্ট করতে চাইবেনা। পেরুর আমাজন অঞ্চলের কিছু শামানদের ব্যাপারে পড়েছিলাম, তারা তাদের পূর্বপুরুষদের মুখের আদলে কাঠ খোদাই করে এমন টোটেম তৈরী করত, যার গড়ন অনেকটা তোমার এই মূর্তিটার সাথে মিলে যায়। তারা মনে করত এগুলো ঐ পূর্বপুরুষদেরকে প্রতিনিধিত্ব করে এবং এগুলোর মাধ্যমে তাদেরকে আবার বাস্তব জগতে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।
মিসির আলী একটু দম নিলেন
- দেখ ইমরান, আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরের যে জগৎ, যাকে আমরা সুপারন্যাচারাল অবস্থা বলি, অনেক মনোবিজ্ঞানীই মনে করেন মৃত্যু মানুষকে ওই স্টেটে নিয়ে যায়। আমার হাইপোথিসিস বলছে, সম্ভবত চৈতন মিয়া কোনভাবে ওই অতিপ্রাকৃতিক অবস্থার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে এবং কোনভাবে মানুষের মৃত্যুকেও ঠেকিয়ে ওখান থেকে ফিরিয়ে আনতে পারে। কিন্তু এই প্রক্রিয়া ক্ষনস্থায়ী, কারন যার চলে যাওয়ার কথা, সে যদি না যায় তবে প্রকৃতির ব্যলান্স নষ্ট হয়। এটা প্রকৃতির নিয়মের সাথে এক ধরনের ফাঁকিবাজী করা বলতে পার। আর এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতেই পরে কোন দুর্ঘটনায় ওই ব্যাক্তিটির মৃত্যু হয়। এক্ষেত্রে মূর্তির আরেকটা ব্যাপার হতে পারে ওই লোকটাকে এক ধরনের সতর্ক বার্তা দিয়ে দেয়া যে তোমার সময় ঘনিয়ে আসছে। কিন্তু বেশীরভাগ মানুষই হয়তো বুঝতে পারেনা, তুমি যেমন ঘটনাক্রমে পেরেছ।
আগামীতে শেষ...