পূর্বেঃ দেখা হয়নি চক্ষু মেলিয়া......, পর্ব-২
পরের দিন সকাল সকাল নাস্তা করে আমরা সবাই বেরিয়ে পড়লাম কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে। প্ল্যানটা এরকম যে, কক্সবাজারে দুপুর নাগাদ পৌছে একটু জলকেলী করে আবার টেকনাফের উদ্দেশ্যে রওনা দিবো। বাসে উঠেই আমি ঘুমানোর পায়তারা করতে লাগলাম। কিন্তু সকলে মিলে সাফল্যের সাথে আমাকে ঘুমাতে দিলো না। এভাবে চলতে চলতে আমাদের ক্ষুধা পেয়ে গেলো। চকোরিয়া আসতে আর কতো দেরী বুঝতে পারছিলাম না। তার একটু পরেই চকোরিয়াতে এসে বাস থামলো। এই হোটেলে আগে কখনো আসি নাই। ছোট লোকাল টাইপ বাসের রেস্টুরেন্ট। এখানে কতক্ষণ থামতে পারে বাস জানার জন্যে আমি বাসের চ্যাংড়া মতন হেল্পারকে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা, বাস এখানে কতক্ষণ থামবে?” ওপাশ থেকে শুধুমাত্র দুটো শব্দের উত্তর এলো, “অষ্টান্নো মিনিট।” উত্তর শুনে আমি হতবাক। পাশে অর্নবও ছিলো। আমরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। বাস এখানে আটান্ন মিনিট থামবে। লে হালুয়া! এক ঘন্টাও না? একেবারে কাটায় কাটায় আটান্নো মিনিট! অর্নব পরে বললো যে, “তোর কথা অস্পষ্ট তো। ও মনেহয় ভেবেছে যে, কক্সবাজার পৌছাতে আর কতক্ষণ লাগবে, এটা জিজ্ঞেস করেছিস।” কিন্তু তাই বলে কক্সবাজারে পৌছাতেও এক ঘন্টা বা দেড় ঘন্টা না, একেবারে প্রেসাইস আটান্নো মিনিট!!?? সেদিন সেই রেস্টুরেন্টে মিষ্টান্নো খাইনি, আর সেই অষ্টান্নো মিনিটের রহস্যও আজ অবধি উৎঘাটন করতে পারিনি।
কক্সবাজারে পৌছানোর পরে সবগুলোর মাথা খারাপ হয়ে গেলো। লাগেজ-টাগেজ সবসহ দৌড়ে দৌড়ে বিচের দিকে ছোটা শুরু করলো। বিচে পৌছেই একটা বসার জায়গা ভাড়া নেয়া হলো। তারপর যে ওরা এরকম বেয়াল্লাপণা শুরু করবে বুঝি নাই। আশেপাশের মানুষজনকে তোয়াক্কা না করে, প্রায় উলঙ্গ হয়ে কাপড় পরিবর্তন করে দৌড়ে দৌড়ে পানিতে নেমে গেলো। শুধুমাত্র আমি আর শুভ্র থেকে গেলাম “হেফাজতে লাগেজ” হিসেবে। সে সময় হাতে থাকা ক্যামেরার সদ্ব্যবহার করতে ভুলি নাই। সাগরের মনোরম দৃশ্য ফ্রেমে বন্দী করার পাশাপাশি ওদের বেশ কিছু নাঙ্গু ছবি তুলে রেখেছিলাম। পরবর্তীতে ঢাকায় এসে বেশ কিছুদিন ওগুলো দিয়েই ব্ল্যাকমেইল করে ভালোই উদরপূর্তি হয়েছিলো।
![https://lh3.googleusercontent.com/-OJgeHtbyVe0/UW1M6ZPEyGI/AAAAAAAAAeI/uYVoDrOCQPQ/s604/21838_1341408419994_4754110_n.jpg]()
ত্রিশ টাকায় কক্সবাজার ভ্রমণ
![https://lh5.googleusercontent.com/-a7wqERSWVdE/UW1M8zraCeI/AAAAAAAAAeY/Vo0aUflEGDU/s604/21838_1341408499996_360422_n.jpg]()
জলকেলীর আনন্দ!
কক্সবাজারে জলকেলী শেষে আমরা টেকনাফের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম বিকেল পাঁচটার দিকে। টেকনাফে পৌছে গেলাম সন্ধ্যা সাতটা সাড়ে-সাতটার দিকে। ওখানেও স্থানীয় একজন সরকারী কর্মকর্তা আঙ্কেলের সৌজন্যে, এরকম পিক-সিজনেও একটা হোটেলে রুম পেয়ে গেলাম। লাল-নীল বাতির হোটেলটা তেমন একটা সুবিধার মনে না হলেও, এটাই নাকি এখানকার সবচেয়ে আলিশান হোটেল! হোটেলে সবাই একটু ফ্রেশ হয়ে নিলো। আমি, শুভ্র আর অর্নব সবার আগে ফ্রেশ হলাম। এ সময় চায়ের তৃষ্ণা মেটাতে ভাবলাম একটু বাইরে যাই। শুভ্রকে না নিয়ে অর্নবকে নিয়ে বের হলাম।
শুভ্রকে না নেয়ার একটা কারণও আছে। ওকে নিয়ে বের হওয়া মানে বিরাট বিপদ সাথে নিয়ে বের হওয়া। ছেলেদের সবচেয়ে দুইটি প্রয়োজনীয় জিনিস সে ব্যবহার করেনা। এর মধ্যে একটা হচ্ছে মানিব্যাগ। আর অন্যটা হচ্ছে মোবাইল। এজন্যে সে প্রত্যেক ট্যুরে একজন করে পার্সোনাল ম্যানেজার নিয়োগ দেয়! এই ট্যুরে তার ম্যানেজার ছিলো নাহিদ। ট্যুরে শুভ্রর টাকা-পয়সা এবং মোবাইলে কলের ব্যাপারগুলো নাহিদ ডিল করে। সে সময় নাহিদ ফ্রেশ হচ্ছিলো। আর ম্যানেজার ছাড়াতো আর শুভ্র বাইরে বের হতে পারেনা। ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে, ও মাস্টার্সের থিসিস করার সময় প্রথম মোবাইল ব্যবহার করা শুরু করে। সেটাও ওর বাবার। ছেলে খুবই ভালো। একবার গ্রাফিক্স কার্ড কেনার জন্যে টাকা-পয়সার দরকার ছিলো। কথা প্রসঙ্গে একদিন সে কথা ওকে বলেছিলাম। পরেরদিনই দেখি পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে হাজির। টাকাটা আমার হাতে দিয়ে বললো, “নে। কার্ড কেন। বাপের দেয়া বাজার আর টিউশন ফির টাকা মাইরা আম্মার কাছে রাখছিলাম। পরে এক সময় শোধ দিয়া দিস। ” এরকম অদ্ভুত মানুষ যে শুধু গল্প-উপন্যাসে থাকেনা, বাস্তবেও থাকে, তা শুভ্রকে দেখে বুঝেছিলাম।
আমি আর অর্নব স্থানীয় একটা বাজারে গেলাম। বাজারে অনেক বার্মিজ প্রোডাক্টের দোকান। লক্ষ্য করলাম যে, সবাই অদ্ভুত এক স্থানীয় ভাষার কথা বলছে। পরে জেনেছিলাম যে, ওটা আরাকানী ভাষা। যদি বাংলা বলে তবে সেটাও আরাকানীর সাথে মিশিয়ে আরও অদ্ভুত হাইব্রিড ভাষায় পরিণত করে। আমরা ঘুরতে ঘুরতেই অন্যরাও এসে পড়লো। ওরা যখন দরদাম করে বার্মিজ স্যান্ডেল কিনছিলো, তখন আমি আর অর্নব একটা চায়ের দোকান খুজে পেলাম। চা খাওয়ার জন্যে দোকানে বসলাম। বললাম, “ভাইগ্না, একটা লাল চা, আর একটা দুধ চা দাও।” সময় গড়ালো। একটু পরে ভাইগ্না দুইটা কাপ এগিয়ে দিলো। খানিকটা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলাম যে, আমার লাল চা ঠিকঠাক থাকলেও, অর্নবের দিকে বাড়িয়ে দেয়া কাপটায় চা নামক তরল পদার্থের রঙ সাদা! সারাদিনের জার্নি আর ক্ষুধায় ক্লান্ত, ফর্সা অর্নবের চোখমুখ তখন রাগে লাল চায়ের বর্ণ ধারণ করা শুরু করেছে। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে কিছু বলার আগেই অর্নবকে থামিয়ে, তাড়াতাড়ি দোকানীকে উদ্দেশ্য করে বললাম, “ভাইগ্না, একটা টি-ব্যাগ দাও দেখি।” ভাইগ্না টি-ব্যাগ দিলে সেটা সুন্দর করে অর্নবের কাপের দুধে চালান করে দিলাম। হয়ে গেলো দুধ চা। আমরা এই ঘটনা থেকে শিক্ষা পেলাম যে, টেকনাফের স্থানীয় লোকজন শুধু যে বাংলা বলতে পারেনা তা নয়, বাংলা বললে বুঝতেও পারেনা। পরেরদিন সেন্টমার্টিন্সে গিয়ে আরও একটা জিনিস আবিষ্কার করেছিলাম যে, এরা যেভাবে আরাকানী অ্যাক্সেন্টে বাংলা বলে, ঠিক সেভাবেই লেখে।
[চলবে]