২০০৬ সালে ক্ষমতা ছাড়ার পর থেকেই বিএনপি খারাপ সময় অতিক্রম করছে। নানা বিপদ-বিপর্যয় বিএনপিকে নাজুক অবস্থায় এনে দাঁড় করেছে। একের পর এক ভুল সিদ্ধান্তের কারণে অনেক চেষ্টা করেও বিএনপি শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াতে পারছে না। ২০০১ সালের নির্বাচনে জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে প্রতিদ্বন্দিতা করে অপ্রত্যাশিত সাফল্য অর্জন করেছিল বিএনপি। ব্যাপক বিজয়ের এক মেয়াদ শেষেই তাদের মহাবিপর্যয় প্রত্যাশিত ছিল না। ২০০১-এর নির্বাচনে বড় বিজয়ই হয়তো বিএনপির জন্য কাল হয়েছিল। বর্তমানে বিএনপি নানা সমস্যায় জর্জরিত। সাংগঠনিক দিক থেকেও বিএনপির এখন চলছে ভঙ্গুর দশা। দলের মধ্যে নানা ধরনের টানাপড়েন চলছে। রয়েছে গ্রুপিং নেতৃত্বের মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাসের সংকট। দলের মধ্যে গণতান্ত্রিক রীতিনীতির চর্চা না থাকায় সমস্যা এত প্রকট হয়েছে যে, খালেদা জিয়া নিজে উদ্যোগ নিয়েও জট খুলতে পারছেন না। একদিকে সন্ত্রাস-নাশকতার অভিযোগে হাজার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা, অন্যদিকে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত চরম কোন্দল-দলাদলিতে বিএনপি ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। ২০০৯ সালের ১ সেপ্টেম্বরের একটি জাতীয় দৈনিকের পাতায় খালেদা জিয়া লিখেছেন ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে জিয়াউর রহমান এসেছিলেন আকস্মিকভাবে। কিন্তু তার আগমন ছিল অবশ্যম্ভাবী। নেতৃত্বের শূন্যতা পূরণ করতে সময়ের চাহিদা এবং দেশের দাবিতে তিনি রাজনীতিতে এসেছিলেন। কোনো চোরাগোপ্তা পথে নয়, রাতের অন্ধকারে ষড়যন্ত্র করে নয়, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর নতুন ভোরের আলোয় সর্বস্তরের লক্ষকোটি মানুষ এবং দেশপ্রেমিক সৈনিদকদের মুহুর্মুহু স্লোগান আর পুষ্পবর্ষণের মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে জিয়াউর রহমানের অভিষেক হয়েছিল। দেশের নেতৃত্ব চলে এসেছিল তার হাতে।’ কিন্তু রাজনীতিতে জিয়াউর রহমানের অভিষেক সম্পর্কে খালেদা জিয়া যে সহজ-সরল-নির্দোষ বর্ণনা দিয়েছেন, প্রকৃত সত্য কি তাই? রাজনৈতিক অঙ্গনে জিয়াউর রহমান কি সত্যি আকস্মিকভাবে এসেছিলেন নাকি অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে পরিস্থিতি ও সুযোগের সদ্ব্যবহার করে তিনি তার আগমন অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিলেন? জিয়ার জীবনের কয়েকটি ঘটনা বিশ্লেষণ করলে এটা প্রমাণ করতে কষ্ট হবে না যে, তিনি ছিলেন অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী। এই উচ্চাভিলাষ বাস্তবায়নের জন্য প্রকৃতপক্ষে পেছন থেকে কলকাঠি নেড়েছেন, সহজ কথায় বললে উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য চোরাগোপ্তা এবং রাতের অন্ধকারে ষড়যন্ত্রের পথই তিনি বেছে নিয়েছিলেন। এটা যারা অস্বীকার করে তারা ইতিহাসের সত্যকে হয় আড়াল করতে চায় অথবা স্বীকার করতে কুণ্ঠাবোধ করে। খালেদা জিয়ার মতে, নেতৃত্বের শূন্যতা পূরণে জিয়া রাজনীতিতে এসেছিলেন। প্রশ্ন হলো, নেতৃত্বের এই শূন্যতা কীভাবে তৈরি হয়েছিল? কে বা কারা করেছিল? বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করে, জেলখানার মধ্যে চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করে যারা দেশকে নেতৃত্ব শূন্য করেছিল, তাদের সঙ্গে কি জিয়াউর রহমানের কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না? স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেনারেল কে এম সফিউল্লাহকে সেনাবাহিনী প্রধান নিযুক্ত করায় জিয়াউর রহমান অসন্তুষ্ট ও ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। এই অসন্তোষ ও ক্ষোভ তিনি গোপন রাখতে পারেননি। অনেকেরই তা জানা। তাছাড়া বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে যারা রাজনৈতিক পটপরিবর্তন করার ষড়যন্ত্র করেছিল, তাদের সঙ্গে জিয়ার যে যোগাযোগ ছিল তা মার্কিন গোপন দলিলপত্রের মাধ্যমে এখন প্রকাশ হয়ে পড়ছে। আত্মস্বীকৃত খুনিরাও জিয়ার সম্পৃক্ততার কথা একাধিকার প্রকাশ্যে বলেছে। এই খুনিদের প্রতি যে জিয়ার বিশেষ দরদ বা অনুকম্পা ছিল সেটাও বোঝা গেছে তাদের বিদেশি দূতাবাসে চাকরি দেয়া এবং হত্যার অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি দেয়ার ঘটনা থেকেই। বিএনপি যদি সত্যি কেন্দ্রের অর্থাৎ মধ্যপন্থার দল হতো, তাহলে দ্বিধাহীন চিত্তে তার প্রশংসা করা যেতো। কিন্তু এখন বিএনপি তো ডানের দিকে, প্রতিক্রিয়ার দিকেই ঝুঁকে পড়েছে বেশি মাত্রায়। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা, জাতীয় স্বার্থের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বার্থের অনুকুল অর্থনৈতিক কর্মসূচিই মধ্যপন্থার রাজনীতির বড় বৈশিষ্ট্য- যা থেকে অনেক দূরে দাঁড়িয়ে বিএনপি। বিএনপির রাজনীতি বামের ডানে তাতে কোনো সন্দেহ নেই কিন্তু ডানের বামে কোনোভাবেই নয়। ধর্মীয় ও উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পৃষ্ঠপোষক জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে মাখামাখি করে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে দৃঢ় অবস্থান না নিয়ে তাদের রাজনীতি বরং এখন ডানেরও ডানে গিয়েছে।
↧