Quantcast
Channel: প্রজন্ম ফোরাম
Viewing all articles
Browse latest Browse all 15150

আটপৌরে প্রলাপঃ ৪

$
0
0

সেপ্টেম্বর ২০১৬... দেশে গিয়েছিলাম মায়ের সাথে ঈদ করতে। ৪৫ দিনের ছুটি, গিটারটা রেখে যেতে মন চাইছিলো না। একটা ব্যাকপ্যাক, মাঝারি সাইজের একটা লাগেজ আর গিটার। এমন কিছু ব্যাপারও না যে নিয়ে যাওয়াটা কষ্টের।

প্রাকঃ যাত্রা বিবরণী বাদ দিয়ে এয়ারপোর্টে চলে যাই। চাঙ্গি এয়ারপোর্ট চমৎকার একটা ব্যাপার... আমার মতো তৃতীয় বিশ্বের একজন মানুষের কাছে তো বটেই। সবকিছুই সুশৃঙ্খল, কোথাও কোন অব্যবস্থাপনা দেখবেন না আপনি।

তিনটা পঁয়তাল্লিশে ফ্লাইট, দুইটার আগেই বোর্ডিং কার্ড পেয়ে গেলাম। লাগেজটা বুকিংয়ে দেয়ার সময় বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স কাউন্টারের বিদেশী ভদ্রমহিলা নিজে থেকেই জানালার পাশে বসতে আগ্রহী কিনা জিজ্ঞেস করলেন। তারপর গিটারের হার্ডকেস নেই জানিয়ে অনুরোধ করতেই আমাকে বললেন, "তুমি গিটারটা সাথে নিয়েই চলে যাও। আমি বোর্ডিং পাসের পেছনে লিখে দিয়েছি, কেউ জিজ্ঞেস করলে এটা দেখাবা। আই লাইক দ্যাট ইন্সট্রুমেন্ট... হ্যাভ এ সেইফ এন্ড ওয়ান্ডারফুল জার্নি টু হোম, স্যার!"

আমি কৃতজ্ঞচিত্তে ধন্যবাদ জানিয়ে এগিয়ে যাই। মনটা ভীষণ প্রফুল্লতায় ভরা।

তারপর কাস্টমসের ছাড়পত্রও পেয়ে গেলাম দ্রুত। হাতে অনেকটা সময়। অপেক্ষা শুধু সেই বাহনের যা আমাকে নিয়ে যাবে আমার মায়ের কাছে।

ট্রিপস এ্যাডভাইজর ডটকমে চাঙ্গির একটা জায়গার কথা পড়েছিলাম, খুঁজে খুঁজে চলে গেলাম সেখানে। নিরিবিলি জায়গাটা একটা স্মোকিং জোন... অবাধ বাতাস, সামনে পুরো রানওয়েটা দেখা যায়। বসে বসে গিটার বাজিয়ে সময় কাটিয়ে দিলাম। আমি আসলে তখন হাওয়ায় ভাসছি... সবকিছুই ভালো লাগছে! আপনি কখনও দেশের বাইরে লম্বা সময় কাটিয়ে দেশে ফিরেছেন? না হলে এই বাড়ি ফেরার ব্যাপারটা বুঝবেন না!

যথাসময়ে নির্দিষ্ট টার্মিনালের চেকপয়েন্টে গিয়ে দাঁড়ালাম। এই ধাপটা পেরুলেই সাধের উড়োজাহাজ! ব্যাকপ্যাক, গিটার স্ক্যানারে দিয়ে বেল্ট, ওয়ালেট, সেলফোন একটা ট্রেতে রেখে মেটাল ডিটেক্টর পার হলাম। তারপর বোর্ডিং পাস চেকিং। দাঁড়িয়ে আছি বেশ কিছুক্ষণ, ঈদের ছুটিতে লোকজনের ভীড় প্রচুর। কাউন্টারের কাছাকাছি চলে এসেছি, এক ভদ্রলোক (?) এগিয়ে এলেন। বাংলাদেশী... চেহারাই বলে দেয়। তারপরও গিটারের ব্যাগের দিকে ইঙ্গিত করে ইংরেজীতে প্রশ্ন করলেন, "এটা নিয়ে যে প্লেনে উঠবেন, রাখবেন কোথায়?"

সত্যি বলতে কি, একটু দমে গেলাম! জীবনে বহুবার বাসে গিটার নিয়ে যাতায়াত করেছি। কিভাবে দুপায়ের মাঝখানে গিটার নিয়ে যেতে হয়, জানা আছে। কিন্তু বিমানে এই প্রথম। চেহারা দেখেই বুঝেছি ভদ্রলোক বাংলাদেশী, তিনিও নিশ্চয়ই বুঝেছেন আমার জাতীয়তা। তবুও তিনি যেহেতু ইংরেজীতে প্রশ্ন করেছেন তাই তাকে আমার সেরা ইংরেজীতেই বললাম যে কাউন্টারের ভদ্রমহিলা আমাকে নিয়ে আসতে বললেন, বলেছেন কোন সমস্যা হবে না। তারপরেও হ্যান্ডক্যারি রাখার জায়গাটা যথেষ্ট না হলে দুপায়ের মাঝখানে...!

আমার কথা থামিয়ে দিয়ে তিনি বললেন, "আর ইউ শিওর? এভাবে যেতে পারবেন? আপনি এটা বুকিংয়ে দ্যান নাই কেন? আমার কেবিন ক্রুরা যদি আপত্তি করে, আমি এটা রাবিশ বিনে ফেলে দেয়ার ব্যবস্থা করবো!"

আমি সবিনয়ে বললাম, "জনাব, আমার গিটার আপনার কাছে 'গুডস'... কিন্তু আমার কাছে এটা 'ইনস্ট্রমেন্ট'! গিটার ফেলে দেয়ার আগে আমাকে ফেলতে হবে রাবিশ বিনে, তারপর আমার গিটার! প্লিজ নোট দ্যাট, আমি কিন্তু জানি এয়ারলাইন্সের ইন্টারন্যাশনাল 'ল' মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট ক্যারি করার ব্যাপারে কি বলে!"

কথার পিঠে কথায় ব্যাপারটা বাকবিতণ্ডায় পরিনত হচ্ছে যখন, একজন মালে ভদ্রমহিলা এগিয়ে এলেন। তাকে বললেন, "স্যার, আমি দেখছি ব্যাপারটা।"

আমি তাকে বুঝিয়ে বললাম বিষয়টা। মহিলা আমার কানের সাথে প্রায় মুখ লাগিয়ে বললেন, "ভদ্রলোক আমাদের ম্যানেজার। তোমার দেশের লোক। আচরণ একেবারেই ফালতু! প্লিজ কিছু মনে করো না। আমি বুঝি একজন মিউজিশিয়ানের কাছে তার ইন্সট্রুমেন্ট কতটা মূল্যাবান! তুমি ওইখানে গিয়ে বসো, যা করার আমি করছি।"

তারপরের ব্যাপারগুলো আর নাই বললাম। আমার নিজের দেশের সেই 'ম্যানেজার' ভদ্রলোক যা করেননি, এই মালে মহিলার কাছে তা পেলাম। বিমানে উঠার পর একজন বাংলাদেশী এয়ারহোস্টেজ এসে বললেন, "আপনি নাকি অমুকের (সেই মালয় ভদ্রমহিলা) বন্ধু? কিছু প্রয়োজন হলে দয়া করে আমাকে বলবেন! আপনার যাত্রা শুভ হোক স্যার!"

বিমানের ক্রুদের বাজে ব্যবহারের অসংখ্য গল্প শুনেছি জীবনে। কিন্তু এটা ছিলো আমার জীবনের সেরা জার্নি! এতোবার এসে তারা আমার খোঁজ নিয়েছেন, শেষেরদিকে আমি লজ্জাই পাচ্ছিলাম! পাশে যে ভদ্রলোক বসেছিলেন, তিনিও অনেক হেল্প করেছেন, কৃতজ্ঞতা তার প্রতিও।

তারপর ঢাকা বিমানবন্দরে ভাইয়ার পরিচিতির সুবাদে যে 'রিসেপশন' পেয়েছি, সেটাও বলা বাহুল্য!

এতো কথা বলার কারন এখন বলি। এই ভ্রমণ আমাকে একটা শিক্ষা দিয়েছে! ওই যে ভদ্রলোক, যিনি বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সিঙ্গাপোর কাউন্টারের ম্যানেজার... তিনি শিক্ষাগতভাবে যথেষ্ট যোগ্য বলেই কাজটা পেয়েছেন, আমার বিশ্বাস! তারপরও কি তিনি 'শিক্ষিত'? প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তাকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলো লাগেজ আর গিটারের পার্থক্য?

শিল্পবোধ অর্জনের জন্যে আপনাকে আরেকটু শিক্ষিত হতে হয়। পুঁথিগত বিদ্যায় সব অর্জন যে হয় না, জীবনের পদে পদে এর উদাহরণ পাচ্ছি... পাবো জানি।

বড় ডিগ্রি, গালভরা চাকরির পদবী আপনাকে সাময়িক অহংকার এনে দিতে পারে, অর্থ-প্রতিপত্তি এনে দিতে পারে, পারে সমাজের সাধারন মানুষের কাছে সম্ভ্রম এনে দিতে... ব্যাস! কিন্তু বিশেষ কোন এক জায়গায় আপনি নিজেই উপলব্ধি করবেন, সেই স্থান-কালে আপনি নিজের কাছে ছোটলোকই থেকে যাবেন।

ভদ্রলোক বড় চাকরি করেন, জীবনে অর্জনও নিশ্চয়ই খারাপ না। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ভদ্রলোক আমার মতো নগন্য একজন মানুষের কাছে 'অশিক্ষিত-চামার'! গ্লানিবোধের জন্যে আর কিছু লাগে কি?


Viewing all articles
Browse latest Browse all 15150

Trending Articles



<script src="https://jsc.adskeeper.com/r/s/rssing.com.1596347.js" async> </script>