দিনের শুরুর ঘটনা
নভেম্বরের দুই তারিখ, ২০১২ সাল, ভোরবেলা। শহরের অন্যতম ব্যস্ত এলাকা ভদ্রার মোড় থেকে কিছু দূরের ঘটনা। সকালে কাজে বের হওয়া লোকজন খেয়াল করলেন রাস্তার পাশে একটা মুখ বন্ধ বস্তা পরে আছে। বস্তাটা বেশ বড় এবং বোঝা যাচ্ছে ভিতরে কিছু আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই কৌতূহলী মানুষের ভিড় জমে গেল। ভিতরে কি আছে সে নিয়ে চলছে জল্পনা-কল্পনা। কেউ একজন পরামর্শ দিল বস্তা খুলে দেখা হোক ভিতরে কি আছে। ‘যদি উল্টা পাল্টা জিনিস থাকে? পুলিশকে খবর দেওয়াই ভাল'। আরেকজনের পরামর্শ। এর মাঝেই এক উৎসাহী যুবক বস্তার মুখ খুলে ফেলল।
ওরে বাবা! উপস্থিতদের চাপা আর্ত-চিৎকার। বস্তা ভিতর থেকে এক মেয়ের লাশ বের হল। বয়স ২৫ থেকে ৩০ এর মধ্যে। শাড়ি পরা, গলায় ওড়না পেঁচান। প্রথম দেখায় মনে হল ওড়না দিয়ে ফাঁস দিয়ে মেয়েটিকে মারা হয়েছে। পুলিশকে খবর দেয়া হল। কোথা থেকে খবর পেয়ে যেন, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার লোকজনও ক্যামেরা হাতে চলে আসল। খবরের রিপোর্ট তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো তারা। কিছুক্ষণের মধ্যে পুলিশ এসে লাশটা নিয়ে গেল।
আমার কাহিনী
সে দিন দুপুরের ৩টার সময়ের কথা। বসায় অলস সময় কাটাচ্ছি। ল্যাপটপে কি যেন একটা মুভি দেখছিলাম। এর সময় কোয়ান্টাম থেকে ফোন আসল। পুলিশ একটা বেওয়ারিশ লাশ নিয়ে এসেছে। কোয়ান্টাম লাশ দাফনের দায়িত্ব নিয়েছে। বিকেল ৫টার সময় দাফন হবে। আমি দাফনের কাজে থাকতে পারব কিনা জানতে চাইল। মুভি দেখে অলস সময় পার করার থেকে এটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হল। দ্রুত রেডি হয়ে কোয়ান্টামের অফিসে রওনা দিলাম।
অফিসে গিয়ে শুনলাম কবর খননের কাজ চলছে, একটা টিম সেখানে কাজ করছে। আর লাশের ময়না তদন্তের কাজ এখনও শেষ হয়নি। এক দায়িত্বশীল কাগজ পত্র সাথে নিয়ে মর্গে রওনা দিলেন। লাশ ছাড়িয়ে নেবার জন্য। আমিও তার সাথী হলাম।
মর্গে গিয়ে দেখি কাজ চলছে। লাশের দায়িত্বে থাকা পুলিশরা দাঁড়িয়ে আছে। দুই জন পুরুষ আর একজন নারী পুলিশ। লাশের কাগজ পত্র দেখে জানলাম- মহিলার লাশ, বয়স আনুমানিক ২৫-৩০, শ্বাস রোধ করে হত্যা করা হয়েছে। লাশের বাকি ঘটনা পুলিশের কাছ থেকে জানলাম। যেহেতু মহিলার লাশ তাই লাশ ঘরে ঢুকলাম না। তা ছাড়া এমনিতেও ময়নাতদন্ত দেখা মোটেও সুখকর অভিজ্ঞতা না।
এর মাঝে এক ঘটনা ঘটে গেল। যে মহিলা পুলিশ (কনস্টেবল) ছিলেন, তিনি কি মনে করে যেন ময়না তদন্তের সময় লাশ ঘরে ঢুকেছিলেন। অন্য পুলিশরাও ঢুকে ছিলেন। কিন্তু লাশ কাটার দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে মহিলাটি মাথা ঘুরে পড়ে যান। তাকে বাইরে বের করা হলে সমানে বমি করতে থাকেন। ভাগ্যক্রমে সেখানে সে সময় ডাক্তার ছিলেন। (ময়না তদন্তের সময় এক জন ডাক্তার থাকতে হয়। সাধারণত তারা প্রয়োজনীয় পরীক্ষা শেষে দ্রুতই চলে যান।) ডাক্তার সেই মহিলা কনস্টেবলের চিকিৎসা করতে লাগলেন। কিন্তু মহিলা কিছুতেই স্বাভাবিক হচ্ছিলেন না। শেষে তাকে কি যেন একটা ইনজেকশন দিতে বমি থামল। কিছুক্ষণ পর তাকে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হল।
এর মাঝে লাশঘর থেকে খবর আসল- ময়না তদন্ত শেষ। আমি ভিতরে গেলাম লাশ দেখতে। লাশটা চাদর দিয়ে ঢাকা। মুখটা একটু ফোলা কিন্তু অক্ষত। এরপর এক পুলিশ আলামত হিসাবে মৃত মহিলার পোশাক নিয়ে গেল। অন্য জনও লাশ আমাদের কাছে দিয়ে চলে যেতে চাইল। আমরা জানালাম লাশ দাফন শেষ হওয়া পর্যন্ত আমাদের সাথে লাশের দায়িত্বে থাকা পুলিশকে থাকতে হবে। লাশটি মর্গ ছাড়িয়ে নিয়ে আমরা ভ্যানে করে চললাম হেতেম খাঁ গোরস্থানে কবর দেয়ার জন্য। ততক্ষণে বিকাল ৫.৩০ বেজে গেছে। গোরস্থানে গিয়ে দেখলাম কবর খনন প্রায় শেষের দিকে। কিন্তু আমরা অপ্রত্যাশিত অন্য বিপদে পড়লাম।
বেয়াওরিশ লাশ কোন মহিলার হলে আমাদের কাজ আর একটু কঠিন হয়ে যায়। এমনিতেই এসব দায়িত্বে কেউ থাকতে চায় না। তার উপর মহিলার লাশ গোসলের সময় কোন পুরুষ থাকার অনুমতি নেই। অপর দিকে বেওয়ারিশ লাশ প্রায় সব সময় কিছুটা বিভৎস হওয়ায় সাধারণ মহিলারা গোসল করাতে ভয় পান। সাধারণত দুজন স্থানীয় মহিলা আমাদের বেওয়ারিশ লাশ (মহিলা) গোসল করানো এবং কাফনের কাপড় পড়ানোর দায়িত্ব পালন করে থাকেন। উনারা অত্যন্ত দরিদ্র কিন্তু খুব আন্তরিকতার সাথেই এই কাজ করেন। বিনিময়ে আমাদের কাজ থেকে খুব সামান্য সহযোগিতা নেন। তাদের খবর পাঠান হয়েছিল। বিকাল পাঁচটার মধ্যে তাদের কবরস্থানে চলে আসার কথা। কিন্তু আমরা গিয়ে দেখলাম কেউ আসেননি। খোঁজ নিয়ে জানা গেল একজন খুব অসুস্থ আর অন্য জন ঈদ উপলক্ষে রাজশাহীর বাইরে।
এই খবরে আমরা একটু ভাবনায় পড়লাম। আগেই বলেছি এসব লাশ গোসল করানোর মত মহিলা পাওয়া কঠিন। তার উপর এখন ঈদের ছুটি। আমারা বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ করতে লাগলাম সাহসী কাউকে পাওয়া যায় কিনা। এদিকে সন্ধ্যার আজান হয়ে গেল। আস্তে অন্ধকার নেমে আসছে। লাশটা কবরস্থানের লাশ ধোয়ার ঘরে নামিয়ে রাখা হয়েছে। কোন বিচিত্র কারণে গোরস্থানে লাইট গুলি কিছুক্ষণ পর পর বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল এবং আরও অদ্ভূত কারণে লাশ ধোয়ার ঘরে কোন বিদ্যুতের ব্যবস্থা নেই। আবছা অন্ধকারে আমরা গোটা দশেক মানুষ গোরস্থানে অপেক্ষা করছি। আলো বলতে সাথে আনা তিনটি চার্জার লাইট।
এভাবে ঘণ্টা দুয়েক পার হয়ে গেল। সম্ভাব্য কোন সব জায়গাতে খোঁজ করেও কোন ইতিবাচক খবর পেলাম না। আমরা সেন্টারের অফিসেও বার বার খোঁজ নিচ্ছিলাম। এসময় আমার বড় ভাই ফোন করে জানালেন তিনি তার বউকে (মানে আমাদের ভাবীকে) পাঠাচ্ছেন লাশ ধোয়ার জন্য। শুনে আমাদের মাথা খারাপ হবার জোগাড়। খুব নরম সরম মানুষ। এ ধরনের কাজ কোন দিন করেননি। তিনি এই রাতের বেলা এসে অন্ধকার ঘরে ময়না তদন্ত করা লাশ ধোবেন! কল্পনাই করতে পারছিলাম না। আমাদের মেহেদী৮৩ ভাই আমার অবস্থা কিছুটা কল্পনা করতে পারবেন। কারণ তিনি সরাসরি ভাবীকে দেখেছেন। আমি ভাইয়াকে আপত্তি জানালাম। ভাবীর আগের কোন অভিজ্ঞতা নেই, ভয় পেতে পারেন তাও বললাম। বিশেষত মহিলা কনস্টেবলের ঘটনায় আমাদের ভয় আরও বেড়ে গিয়েছিল। ভাইয়া বললেন, আর কোন মেয়ে তো পাওয়া যাবে না। তার মতে বড় কথা বলার চাইতে ভাল কাজের সুযোগ থাকলে তা গ্রহণ করাই উত্তম। আর সব কিছু শুনে ভাবী নিজেই নাকি আগ্রহ প্রকাশ করেছেন আসার জন্য। আমাদের হাতে আর কোন বিকল্প ছিল না, তাই রাজি হলাম।
ভাবী আমার ছোট ভাইকে নিয়ে বাসা থেকে বের হলেন। এ দিকে ভাবী এর আগে কখনই লাশ ধোয়াননি। নিয়ম কানুনও ভাল জানেন না। তাই আমরা আবার সেই স্থানীয় মেয়েটির কাছে (যিনি অসুস্থ) লোক পাঠালাম। বললাম, আপনাকে কিছু করতে হবে না। শুধু দেখিয়ে দিবেন কিভাবে কি করতে হয়। উনার প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতা, অসুস্থ শরীরে তিনি আসতে রাজি হলেন।
ভাবী এবং সেই মহিলা আসার পর আনুমানিক রাত ৮.০০ টার দিকে লাশের গোসল করানো শুরু হল। ভাবীকে নিয়ে খুব ভয় করছিলাম। আল্লাহর রহমতে তিনি দেখি খুব দারুণ ভাবেই সব সামলে নিলেন। শুধু মাত্র প্রথমবার লাশ দেখে হালকা চিৎকার দেওয়া ছাড়া।
লাশ গোসল করানোর পর জানাজার নামাজ পড়ে কবরে নামান হল। দাফনে আমি থাকলে সাধারণত কবরে নামি। এবারও তাই করলাম। কবর দেওয়া শেষে মৃতার জন্য প্রার্থনা করা হল। মোটামুটি রাত নয়টার দিকে সব কাজ শেষ হল।
আমি সাধারণত বেওয়ারিশ লাশ দাফন কার্যক্রমে কাজ করার সুযোগ থাকলে মিস করতে চাই না। দাফনের কাজ করতে গিয়ে সম্পূর্ণ একটা অচেনা মৃত মানুষের সাথে কেমন যেন একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাকে যখন কবর দেওয়া বা চিতায় পোড়ান (সনাতন ধর্মের লাশ হলে) সম্পন্ন হয়- ভিতরে এক অদ্ভূত অনুভূতি কাজ করে। একটা প্রশান্তি অনুভব করি। যাক একজনকে তো সম্মানের সাথে শেষ বিদায় দিতে পারলাম। খুব সামান্য হলেও কিছু দায়িত্ব তো পালন করতে পারলাম। সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ, তিনি আমাকে কিছু ভাল কাজের সাথে যুক্ত থাকার সুযোগ করে দিয়েছেন।